শিক্ষকতা ছেড়ে রাজমিস্ত্রি, অটোচালক, ফল বিক্রেতা তাঁরা
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২০, ০৯:২৮ AM , আপডেট: ২৭ জুন ২০২০, ১১:০৭ AM
করোনার প্রাদুর্ভাবে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সংসারের ব্যয় মেটাতে বন্ধ থাকা বেসরকারি ও নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে নেমে পড়ছেন বিভিন্ন পেশায়। দেশের কয়েক হাজার শিক্ষক এখন নিজ পেশা ছেড়ে অন্য কাজ করছেন। পেটের ভাত জোগাড়ের চেষ্টায় দারিদ্র্যের সঙ্গে আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছেন।
কেউ রাজমিস্ত্রি, আবার কেউ মৌসুমি ফলও বিক্রি করছেন। কেউ-বা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালাচ্ছেন। করোনাকাল তাদের জীবনে এসেছে ঘোর অমানিশা হয়ে। বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক তারা। কয়েক মাস বেতন বন্ধ। পেট তো লকডাউন মানে না। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে নেমেছেন কষ্টকর এসব কাজে।
দিনাজপুরের পার্বতীপুরের এক শিক্ষক হাতে চক-ডাস্টারের বদলে তুলে নিয়েছেন কোদাল ও ঝুড়ি। শ্রমসাধ্য রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন তিনি। নিজে অবিবাহিত হলেও বাবা-মা, ভাইবোন, দাদিসহ পরিবারে মোট ৯ জন সদস্য এই শিক্ষকের। নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে বলেন, স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে গত মার্চে। বন্ধের আগে এক মাসের বেতন পেয়েছিলেন, এরপর এ পর্যন্ত আর কোনো বেতন পাননি। যে কাজই হোক না কেন, না করে আর উপায় ছিল না!
বেতন বন্ধ মেহেরপুরের এক শিক্ষক পেটের দায়ে চালাতে শুরু করেছেন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (অটো)। এই শিক্ষক বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় আমি নিরূপায়। এলাকার অনেকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। কিন্তু সংসার তো চালাতে হবে।’
করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ও যথাসময়ে টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় বেতন-ভাতা না পাওয়ায় বেসরকারি শিক্ষকদের পরিবারে এখন দিশেহারা অবস্থা। বেতনের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ তাদের প্রাইভেট-টিউশনও। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন নন-এমপিও শিক্ষকরা।
এছাড়া কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ টানা চার মাস। ফেব্রুয়ারির পর তারা আর বেতন পাননি। বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও পড়েছেন সংকটে। এদিকে আয় কমে যাওয়ায় টিউশন ফি পরিশোধে আগ্রহী নন অভিভাবকরাও।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের গ্রিন লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এক শিক্ষক এখন মৌসুমি ফল আম বিক্রেতা। নিজের স্কুলের সামনেই আম বিক্রি করেন তিনি। বললেন, ‘করোনার জন্য তিন মাস ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় খুবই নাজেহাল অবস্থায় আছি। বাধ্য হয়ে স্কুলের সামনে আম বেচছি।
একইভাবে দুর্দশায় রয়েছে নন-এমপিও কলেজ শিক্ষকরাও। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার একটি বেসরকারি কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের নন-এমপিও এক প্রভাষক জানান, গত এপ্রিল মাস থেকে স্থানীয় কাতলাগাড়ি বাজারে গরু-ছাগলের ওষুধ (ভেটেরিনারি মেডিসিন) বিক্রি শুরু করেছেন তিনি। এভাবে পাওয়া যৎসামান্য আয় দিয়েই কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন তিনি। বলেন, কলেজে আমি অনার্স পড়াই। পেটের দায়েই গরু-ছাগলের ওষুধ বেচতে হচ্ছে এখন!
একই জেলার ‘কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ’র আরেক প্রভাষক অনার্সের ক্লাস নেন। তিনি নিজেও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। কলেজ থেকে টানা তিন মাস বেতন না পেয়ে পেটের দায়ে এই শিক্ষক কষ্টসাধ্য কৃষিকাজে নেমে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিজের দুর্দশার কথা বলতে খুব লজ্জা লাগে! বেশি কিছু বলতে চাই না, বুঝতেও চাই না। শুধু বুঝি- পরিবারের পাঁচ সদস্যের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে হবে।’
দেশে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার নন-এমপিও স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় এক লাখ ১০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। এ বছর দুই হাজার ৭০০ এর কিছু বেশি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ায় এদের মধ্যে ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর সরকারি বেতনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী।
এদিকে বিভিন্ন স্তরের বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য করোনাকালে বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করেছে সরকার। গত বুধবার এই অর্থ ছাড় করা হয়েছে। করোনাকালে লক্ষাধিক নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে বিতরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, শিক্ষকদের এককালীন পাঁচ হাজার ও কর্মচারীদের দুই হাজার পাঁচশ' করে টাকা দেওয়া হবে। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের মাধ্যমে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে এ টাকা বিতরণ শুরু হবে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের তালিকা প্রস্তুত করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এর পরই এ বরাদ্দ দেওয়া হয়।