বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা, যা ভাবছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা

  © টিডিসি ফটো

করোনা সংক্রমণের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান । তবে শিক্ষার্থীদের সেশনজটসহ নানাবিধ সমস্যা এড়াতে ইউজিসির নির্দেশনায় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। চলছে অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমে ইতিবাচক দিক থাকলেও রয়েছে নানান সীমাবদ্ধতা- এমনটাই জানিয়েছেন দেশের পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের ঢাকা ইন্টান্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) প্রতিনিধি সাদিয়া তানজিলা-

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আল মাহমুদ রাজ বলেন, অনলাইনে ক্লাসের নেগেটিভ-পজিটিভ দুটো দিকই রয়েছে। লকডাউনে শিক্ষার্থীরা বেকার বসে আছে, অনলাইনে ক্লাস নিয়ে তাদের শিক্ষাজীবনের এই অচলায়তনের কিছুটা অবসান ঘটানোর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে অনেক ভালো। একজন শিক্ষার্থীর সেশনজট, বয়স বিবেচনায় পজিটিভ দিক থাকলেও এটা বাস্তবায়নে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তারপরেও মন্দের ভালো হিসেবে ডুয়েটে অতি শিগ্রই অনলাইন ক্লাস শুরু করা হলে ডুয়েট শিক্ষার্থীরা সেশনজটের কবল হতে মুক্তি পাবে ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এম. কামিল আহমেদ বলেন, সকল শিক্ষালয় বন্ধ থাকায় পড়াশুনা থেকে দূরে আছে অনেকেই। দীর্ঘদিন যাবৎ বাড়িতে থাকায় অনেকেরই পড়ালেখার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে, কাবু করেছে একঘেঁয়েমিতাও। এমতাবস্থায় শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে অনলাইন শিক্ষা জরুরি। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটানুযায়ী এক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইন্টারনেটের বর্ধিত দাম। তবে, প্রয়োজনীয় উপকরণের সহিত নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে পারলেই এর সুফল ভোগ করবে দেশের সকল শিক্ষার্থী। অন্যথায়, কেবল শহরাঞ্চলীয় শিক্ষার্থীরাই উপকৃত হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের সুফল মিলছেনা গ্রামাঞ্চলে।

তিনি বলেন, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই শিক্ষানির্ভর। কোনো কারণে কেউ ক্লাসে উপস্থিত হতে না পারলে পরবর্তীকালে সুবিধানুযায়ী ক্লাসটি করার সুযোগ তো থাকছেই। ক্লাসগুলো প্রিজার্ভ করা থাকায় পুন:পুন প্লে করে যে কেউ ভালো করে বুঝতে পারবে। এভাবে ক্লাস নেওয়ার প্রাক্কালে কাঠামোগত সক্ষমতা নিশ্চিত করা দরকার। সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট মহলের আন্তরিক সহায়তার প্রয়োজন। এভাবে ক্লাস নেওয়ার পূর্বে শিক্ষক ও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে গভীর আলোচনার মাধ্যমে রসময় করে তুলবেন ক্লাসটি। যেকোনো দুর্যোগেই ক্লাস কার্যক্রম চালানো সহজতর হয়ে যাবে, তরান্বিত হবে শিক্ষার গতিও।

গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর আহম্মেদ বলেন, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকাংশে শিক্ষানির্ভর তবে, সেটা শতভাগ নয়। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই অনলাইন নির্ভর। তবুও সরাসরি শিক্ষা-কার্যক্রমে তাদের দ্বারস্থ হতে হয়। বাস্তবার মুখোমুখি হতে হবেই, শুধুমাত্র টেকনোলজি দিয়ে সবটা করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ব্যবহারিক বিষয়গুলোতে অবশ্যই হাতে কলমে শেখার বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, করোনার সংকটে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। এমন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার আশ্রয় নিতে হয়েছে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু, যে ডিজিটাল ব্যবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা ঠিক কত ভাগ মানুষকে উপকৃত করছে তার চিত্র সকলের কাছে স্পষ্ট। শহর অঞ্চলগুলোতে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনের পুরোপুরি সুবিধাভোগী হলেও কিছু শিক্ষার্থী কার্যত সেটার আওতার বাহিরে। আবার গ্রামের কিছু শিক্ষার্থী ফলভোগী হলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী থাকছে এই সুবিধার বাহিরে। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অলাইন শিক্ষা মোটেও সুখকর নয় তবে একেবারে যে যুক্তিযুক্ত নয় সেটা আমি বলবো না। একদম হা-পা গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে এটা অনেক কাজের। যারা অনলাইন সুবিধার বাহিরে তারা হয়তো পুরোপুরি সুবিধা ভোগ করছে না কিন্তু যারা সুবিধার আওতায় আছে তারা বেশ উপকৃত হচ্ছে। আর যারা সুবিধা নিতে পারছে না তারা একেবারেই সুবিধার বাহিরে না তারাও বিভিন্ন মাধ্যমে বেশ কিছুটা উপকৃত হচ্ছে ।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুর রহিম বলেন, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান সময়ে সময়োপযোগী হলেও অনলাইনে শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনো আমরা দক্ষ হয়ে উঠিনি। শিক্ষকদেরও পর্যাপ্ত মানের প্রশিক্ষণ দেওয়া কিংবা শিক্ষার্থীদের সরঞ্জাম সামগ্রী, ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক সুবিধা, এন্ড্রয়েড ফোন, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ ইত্যাদি নানা বিষয়ে ঘাটতি থেকেই যায়। অনলাইনে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের অলস সময় থেকে হয়তো কিছুটা রেহাই দিতে সহায়ক হতে পারে কিন্তু এটা কখনো শিক্ষা নির্ভর বা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এরপর অনলাইনে থিওরিটিক্যাল ক্লাস এবং ম্যাথমেটিক্যাল ক্লাস নিতে পারলেও প্র্যাকটিক্যাল কিংবা ল্যাব ক্লাসগুলো নেওয়া কখনো সম্ভব না।

তিনি বলেন, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কীল ডেভেলপমেন্ট হিসেবে হয়তো কিছু শিক্ষার্থী তা গ্রহণে সক্ষম হতে পারে বিশেষত যারা শহুরে শিক্ষার্থী, যাদের অনলাইনে ক্লাস করার সরঞ্জাম এবং সামর্থ্য রয়েছে। কিন্তু যারা গ্রামে রয়েছে তাদের অনেকের পক্ষে অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের থেকে উঠে আসা। করোনা মহামারি এসে চলে গেছে বা খুব দ্রুত চলে যাবে এমনও না। সামনের দিনে এমন মহামারী হওয়াও খুবই স্বাভাবিক তাই অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের সবার সহজলভ্য এবং সুযোগ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবী।

ঢাকা ইন্টান্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) ফার্মেসি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তানজিলা আক্তার লিজা বলেন, গত চার মাস যাবৎ আমরা গৃহবন্দি অবস্থায় সময় পার করছি। শিক্ষার্থীদের এক একঘেয়েমিতা কাটাতে আর শিক্ষার সংস্পর্শে রাখতে অনলাইন শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষার বেশ সুবিধা থাকলেও রয়েছে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও। আমাদের অনেক বন্ধু গ্রামে রয়েছে তারা পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক সুবিধা পাচ্ছে না। আবার অনেকেরই অনলাইন ক্লাসের দক্ষতার অভাব রয়েছে।

তিনি বলেন, আমি ফার্মেসি বিভাগের তাই ল্যাবের বিষয়টাও রয়েছে। এছাড়া নিয়মিত অনলাইন ক্লাসে বন্ধুদের সাথে কথার সুযোগ হয়, আমরা মেসেঞ্জারে একটা স্টাডি গ্রুপ খুলেছি এবং নিয়মিত আমরা সেখানে গ্রুপ স্টাডিও করছি ।এছাড়া সকল অপারেটর যেভাবে তাদের নেটবিল বৃদ্ধি করছে তাতে অনেকের ইচ্ছে থাকলেও সামর্থের কারণে ক্লাস করা সম্ভব হচ্ছে না। অনলাইনে দক্ষতা, নেটওয়ার্ক সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে দেশের সকল শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুবিপ্রবি) আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা তুজ জিনিয়া বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনলাইন ক্লাস কিছুটা কঠিন। কারণ আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের অনেকেরই ডিভাইস এবং নেট কেনার সামর্থ্য নেই। আবার আমাদের দেশের অধিকাংশ এলাকায় পর্যাপ্ত নেট স্পিড ও নেই। তবে বর্তমান করোনা প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে অনলাইন ক্লাস ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ও নেই।

তিনি বলেন, অনলাইন ক্লাসের কার্যকারিতা বিষয়ে আমার মনে হয় অনলাইন ক্লাস শুধুমাত্র থিওরিনির্ভর রিলেটেড বিষয়গুলোর জন্যই প্রযোজ্য। সেটিও পুরোপুরি ফলপ্রসূ করতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সদিচ্ছা প্রয়োজন। সঠিকভাবে শিখতে পারলে সেটি অবশ্যই ক্যারিয়ার গঠন বা চাকুরীর বাজারে কাজে লাগবে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে ডিভাইস না থাকা, আর্থিক সমস্যা এবং নেট স্পিডের সমস্যার কারণে প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছেনা।

তিনি আরও বলেন, আমাদের উচিত অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আরো কাজ করা। এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় অভিজ্ঞ শিক্ষক সংকট থাকে। এক্ষেত্র তারা সহজেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে অনলাইনে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করতে পারবে।


সর্বশেষ সংবাদ