১৭ আগস্ট ২০২৫, ১৯:১৭

উপকূলীয় জীবিকা ও জলবায়ু পরিবর্তনে শৈবাল চাষের সম্ভাবনা

সামুদ্রিক শৈবাল আসলে একধরনের সামুদ্রিক সবজি  © টিডিসি

বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত দিন দিন বাড়ছে। লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড়, আর মাছের প্রজাতি হ্রাস—সব মিলিয়ে জীবিকার টানাপোড়েনে পড়ছে উপকূলের মানুষ। তবে এ সংকটের ভেতর দিয়েই উঁকি দিচ্ছে নতুন সম্ভাবনা—সামুদ্রিক শৈবাল চাষ।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগ এবং এআইআরডির যৌথ উদ্যোগে শুরু হয়েছে একটি প্রকল্প—‘পাইলটিং স্মল স্কেল ম্যাক্রোঅ্যালগি কালচার ফর আমেলিওরেটিং লিভলিহুড অব কোস্টাল কমিউনিটিস অ্যান্ড অ্যাড্রেসিং কার্বন ডাই অক্সাইড রেমিডিয়েশন’।

গবেষকদের ভাষায়, এ উদ্যোগ একদিকে যেমন অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খুলে দিতে পারে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় রাখতে পারে বড় ভূমিকা।

বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা আর প্রায় ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার জলরাশি সিউইড চাষের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। দেশে প্রায় ২০০ প্রজাতির সিউইড পাওয়া গেলেও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি। এর মধ্যে উলভা ইনটেসটিনালিস (স্থানীয় নাম ‘ডেললা’) অন্যতম। সহজে চাষযোগ্য, দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া এই শৈবাল শুধু পুষ্টিগুণেই ভরপুর নয়, পরিবেশ থেকে শোষণ করে কার্বন ডাই-অক্সাইডও।

প্রধান গবেষক ড. মো. রাজীব সরকার বলেন, ‘সামুদ্রিক শৈবাল আসলে একধরনের সামুদ্রিক সবজি। এতে আছে উচ্চমানের প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলস। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। শৈবাল থেকে বায়োপ্লাস্টিক ও বায়োডিজেলও তৈরি সম্ভব। বিশেষ করে নারীদের আয়রনের ঘাটতি পূরণে এটি উপকারী। প্রতি কেজি শুকনো শৈবাল প্রায় আধা কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে।’

আরও পড়ুন: পুরুষদের আর্দশ স্বামী বানাতে সেনেগালে জাতিসংঘের বিশেষ স্কুল

বরগুনা, কুয়াকাটা, লেবুরচর, গঙ্গামতি ও চোরপাড়া এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে রশি ও জালে ঝুলিয়ে শৈবাল চাষ করা হচ্ছে। এতে সরাসরি অংশ নিচ্ছেন স্থানীয় জেলেরা। গবেষকদের পর্যবেক্ষণে, গঙ্গামতি ও লেবুরচরে ফলন সবচেয়ে ভালো। চাষের জন্য জমি লাগে না, প্রয়োজন হয় না রাসায়নিক সারও।

শুধু চাষ নয়, এই শৈবাল থেকে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের পণ্য। যেমন নরি শিট (জাপানি সুশিতে ব্যবহৃত প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার), সিউইড ট্যাবলেট (আয়োডিন, আয়রন ও ভিটামিন–১২ সমৃদ্ধ, যা হজম ও থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে) এবং সি উইড আইসক্রিম (দুধের ২৫ ভাগের পরিবর্তে উলভা ব্যবহার করে তৈরি, যা স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তাদের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে)। এ ছাড়া শৈবাল দিয়ে বিস্কুট, জিলাপি, মিষ্টি, রোল, এমনকি সাবান ও ফেসপ্যাকও বানানো হয়েছে।

পরীক্ষামূলকভাবে এসব পণ্য ব্যবহারকারীরা ইতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহজাবিন বলেন, শৈবাল ফেসপ্যাক ব্যবহারে ত্বক ঠান্ডা ও নরম থাকে।

আরেক শিক্ষার্থী আশিকুর রহমানের ভাষায়, ‘খেয়ে দেখলাম, সত্যিই দারুণ স্বাদ। বাজারে এলে চাহিদা পাবে, স্থানীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখবে।’

আরও পড়ুন: ‘আমার স্বামী বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে ফুল দিতে গিয়েছেন’, রিকশাচালক আজিজুরের স্ত্রী চুমকি

গবেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়ও শৈবালের বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রতি কেজি শৈবাল প্রায় ০.৭ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে, যা ‘ব্লু কার্বন’ ধারণার সঙ্গে যুক্ত। ফলে এটি কেবল জীবিকা নয়, জলবায়ু সংকট নিরসনেও কার্যকর।

বর্তমানে ইউএনডিপি, আইএলও এবং ইনোভেশন কনসাল্টিংয়ের সহায়তায় উপকূলের জেলে, নারী ও তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজারে ৪৫–৬০ দিনের এক চাষচক্রে একজন চাষি গড়ে ১২–১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। বিশ্ববাজারে সিউইডের আকার দ্রুত বাড়ছে। ২০২৮ সালের মধ্যে এর আয়তন ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এআইআরডির সহকারী গবেষক ড. মো. আরিফুল আলম বলেন, কুয়াকাটা ও কক্সবাজারে শৈবালের ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। এতে থাকা ওমেগা–৩ ও ওমেগা–৬ ফ্যাটি অ্যাসিড শিশুদের মেধা বিকাশে, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে ও হজমে সহায়ক। এই সম্ভাবনা সারা দেশে ছড়িয়ে দিলে উপকূল হতে পারে টেকসই উন্নয়নের রোল মডেল।

সব মিলিয়ে, উলভা শৈবাল আর দশটা সামুদ্রিক উদ্ভিদের মতো নয়। এটি যেন উপকূলবাসীর জন্য এক নতুন আশার প্রতীক। জলবায়ু সংকটের এই কঠিন সময়ে প্রকৃতির এই সহজ সমাধানই হয়ে উঠতে পারে সবুজ অর্থনীতির নতুন চাবিকাঠি।