করোনাকালে ২৮% শহুরে নারী কর্মী ঋণগ্রস্ত, বিপর্যয়ের শিকার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত
করোনা মহামারির সময় শহুরের বস্তি ও পোশাক কারখানায় কর্মরত নারীদের একটি বড় অংশ চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি, আর্থিক সংকট এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ২৮ শতাংশের সন্তান জন্মদানে অথবা চিকিৎসার খরচ জোগাড়ে ঋণ নিতে হয়েছিল। এতে অনেকে সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেউ কেউ খাদ্যসংকট মেটাতে গিয়ে স্বাস্থ্যহানির মুখে পড়েন। সংকটগুলো শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই নয়, বরং সামাজিক-শারীরিক নিরাপত্তা নিয়েও গভীর প্রশ্ন সৃষ্টি করেছিল।
বুধবার (২৫ জুন) আইসিডিডিআর,বি’র মহাখালীর সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে আয়োজিত সেমিনারে ‘ওম্যান রাইজ’ গবেষণার মূল ফলাফল এবং নীতিগত সুপারিশ নিয়ে আলোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন: সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল গ্রেপ্তার
ডা. সোহানা শফিকের নেতৃত্বে পরিচালিত এই 'ওম্যান রাইজ' গবেষণাটি মহামারির আগে, চলাকালীন এবং পুনরুদ্ধারের সময় বস্তি ও কারখানায় কর্মরত নারীদের অভিজ্ঞতা গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছে। ঢাকা ও গাজীপুরে আইসিডিডিআর,বি-র আরবান হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সারভেইল্যান্স সিস্টেম সাইট এবং গাজীপুরের ছয়টি তৈরি পোশাক কারখানায় এই গবেষণা চালানো হয়।
অনুষ্ঠানে গবেষণার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. সোহানা, কীভাবে কোভিড-১৯ মহামারিতে বস্তি ও কারখানায় কর্মরত নারীরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে পড়েছিলেন এবং শহুরে স্বাস্থ্যসেবায় কী ধরনের ফাঁকফোকর ছিল। পাশাপাশি, গবেষণার মাধ্যমে প্রয়োগ করা বিশেষ উদ্যোগগুলো কীভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে; সেসব চিত্র তুলে ধরেন।
মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, মহামারির কারণে নারী-পুরুষ উভয়ের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সুস্থতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেমন, মিরপুর বস্তির এক ২৮ বছর বয়সী গৃহকর্মী জানান, মহামারির সময় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে খরচের চাপে তাকে কানের দুল বিক্রি করতে হয়েছে এবং ঋণ নিতে হয়েছে, যার ফলে তার মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এর পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে কর্মসংস্থান কমেছে এবং খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।
আরও পড়ুন: উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ছাত্রদলের শুভকামনা
গবেষণায় দেখা গেছে, সুনির্দিষ্ট হস্তক্ষেপের ফলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি এসেছে। শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের বিস্তার পথ সম্পর্কে জ্ঞান সামগ্রিকভাবে ২৯.৫৯% বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের মধ্যে ৩৬.২৮%। লক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা সার্বিকভাবে ২৪.৭১% বেড়েছে, যেখানে আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের মধ্যে ৩১.৬১% এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের মধ্যে ১৯.৬০% বৃদ্ধি দেখা গেছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান সামগ্রিকভাবে ২১.২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে; এতে আনুষ্ঠানিক খাতের ১৮.২৫% বং অনানুষ্ঠানিক খাতের ২৩.৪৩% কর্মী উপকৃত হয়েছেন।
হাত ধোয়ার সঠিক সময় সম্পর্কে জ্ঞানও আনুষ্ঠানিক খাতের ২৪.৭০% এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ২৭.৬৬% কর্মীদের মধ্যে বেড়েছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অনুশীলনও সামগ্রিকভাবে ১৫.৯৫% উন্নতি হয়েছে, যা আনুষ্ঠানিক খাতে ১৬.৯৭% এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ১৫.৪১% উভয় ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। কর্মজীবী নারীদের মধ্যে খান্যের বৈচিত্র্য সামগ্রিকভাবে ১১.৫৮% বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের মধ্যে এটি বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিবন্ধন সম্পর্কে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের জ্ঞান ১৬.২৬% বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা পরিষেবা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে ২৩.৪৩% জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে যা আনুষ্ঠানিক খাতের ১৫.৫০% এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের ১৮.৪১% কর্মীদের মধ্যেই দেখা যায়।
আরও পড়ুন: ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে বাংলাদেশ
অনুষ্ঠানের শুরুতে আইসিডিডিআর,বি-র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ স্বাগত বক্তব্য রাখেন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সিনিয়র সচিব মিসেস মমতাজ আহমেদ এনডিসি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের মাননীয় সচিব ড. সারওয়ার বারী এবং মহিলা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের মাননীয় সদস্য ও জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র ফ্যাকাল্টি ড. হালিদা হানুম আখতার।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আইসিডিডিআর,বি-র হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর ড. সারাহ স্যালওয়ে, আইইডিসিআর-এর পরিচালক এবং এই গবেষণার সহ-প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরিন।
অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতা করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং কানাডার সিককিডস। এই গবেষণায় আর্থিক সহায়তা দিয়েছে কানাডার ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার।