হাসপাতালে জুলাই আহতদের মধ্যে বাড়ছে বিভাজন-দ্বন্দ্ব, ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান পঙ্গু হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন জুলাই আন্দোলনে আহত যোদ্ধারা। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ায় তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে একাধিক গ্রুপ ও সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের কিছু সদস্য সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থ এনে তা নিজেরা ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। আর আহতদের দেওয়া হচ্ছে সামান্য। অনেকেই জানেন না, তাদের নামে কত টাকা এসেছে বা কোথায় তা খরচ হচ্ছে। ‘জুলাই যোদ্ধা সংসদ’, ‘ওয়ারিয়রস অব জুলাই’, ‘ভয়েস অব জুলাই’সহ নানা গ্রুপের মধ্যে এখন চলছে দোষারোপ, বিভাজন ও সন্দেহ।
‘জুলাই যোদ্ধা সংসদ’ নামে জুলাই আহতদের নিয়ে কাজ করছে এমন একটি প্লাটফর্মের সদস্য সচিব আপন বলেন, আমাদের আগে জুলাই আহতদের নিয়ে কাজ করছেন ‘ওয়ারিয়রস অব জুলাই’। আবার ‘ভয়েস অব জুলাই’ নামে সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় আরেকটি কমিটি গঠিত হচ্ছে। এ ছাড়া আরও কিছু গ্রুপ আহতদের নিয়ে কাজ শুরু করেছে। দুঃখজনকভাবে, অনেকেই আজ টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আন্দোলনে আমরা আহতদের নিয়ে বাস্তবিকভাবে কাজ করছি। আমাদের রেকর্ডে আহত তিন হাজার মানুষ আছে। বিশেষ করে সি ক্যাটাগরির আন্দোলনটা শুরুর পর থেকে জুলাই সংসদের লোকজনই করে। সেখানে অন্য কোন সংগঠন ছিল না। তবে ‘ওয়ারিয়রস জুলাইসহ অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে আমরা যমুনাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। জুলাই ওয়ারিয়রস কমিটি—যার আহ্বায়ক আবু বকর এবং সদস্য সচিব সালমান—তারাও তাদের নিজস্ব কিছু দাবি নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছে।’
তবে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। আমার কমিটির আহ্বায়ককে দুইবার ট্রাক দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাকে ফোনে খুনের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এমনকি আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার শর্তে আমাকে ১০ লাখ টাকার অফার দেওয়া হয়েছে।”
আরও পড়ুন: ৪ শর্তে বৃদ্ধি পেল শিক্ষকদের উৎসব ভাতা, সম্মতিপত্র জারি
কেউ কেউ আমাকে বলেন, আন্দোলনে নামার দরকার নেই—চুপচাপ ক্যাটাগরি চ্যাঞ্জ করে চলে যাও। কিন্তু আমি সেই ব্যক্তি যে রাজপথে আন্দোলন করে আহত হয়েছি। আমি শহীদদের ভুলতে পারি না। আজ কিছু লোক টাকার মোহে নীতিহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি এখনও আহতদের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছি। কারণ এটা শুধু আন্দোলন নয়।এটা আমার দায়িত্ব, আমার বিবেক, আমার লড়াই।
এ সময় আহত আরেকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘হাসনাত, সারজিস কিংবা নাহিদের কাছে কিছু বলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। আহতদের নিয়ে সবাই কেবল রাজনীতি করছে।’ তিনি জানান, ব্যক্তিগতভাবে বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। কারণ তাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে কিছু চামচা ও চাটুকার যারা নিজেরাই কেবল কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়—বাকিরা সবসময় উপেক্ষিত হয়। কে কী করছে, কার সঙ্গে কী আলোচনা হচ্ছে—সে বিষয়ে কারো কাছে কোনো স্বচ্ছ তথ্য নেই। বর্তমানে পুরো কার্যক্রমই চলছে এসব চামচাদের মাধ্যমেই। যারা একসময় আন্দোলনের মাঠে ছিলেন, তারাও এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ‘নির্বাচন নির্বাচন’ নিয়ে। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ছিল মাত্র ৫ বা ১০ দিনের মধ্যেই শহীদ ও আহতদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে দেওয়া।’
আরও পড়ুন: প্রিলি পাস করা সারজিস-হাসনাত কি ৪৬তম বিসিএসের রিটেনে অংশ নেবেন?
সূত্র জানায়, জুলাই আহতদের সহায়তার জন্য সরকার তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে আর্থিক সুবিধা নির্ধারণ করেছে। ক্যাটাগরি ‘এ’-তে রয়েছে তারা, যাদের দুটি অঙ্গহানি হয়েছে। তারা প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা এবং এককালীন ৫ লাখ টাকা সহায়তা পায়। এ রকম আহতের সংখ্যা ৪৪৮ জন। ক্যাটাগরি ‘বি’ হলো যাদের হাত, পা বা নাক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের জন্য মাসিক ভাতা ১৫ হাজার টাকা এবং এককালীন ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে।যার সংখ্যা প্রায় ৯০০ জন। ক্যাটাগরি ‘সি’-তে রয়েছে তারা, যারা আন্দোলনে গুলি বা রাবার বুলেটের শিকার হয়েছিল কিংবা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে এখন সুস্থ হয়ে উঠেছে। .
এদের এককালীন সহায়তা ১ লাখ টাকা এবং মাসিক ভাতা ১০ হাজার টাকা। বর্তমানে ক্যাটাগরি ‘সি’-তে গেজেটভুক্ত আহতের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫০০ জন। আরও ৩ হাজার ৫০০ জনকে গেজেটভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।
সূত্র আরও জানায়, এই আহতদের নিয়েও চলছে রাজনৈতিক দুর্ব্যবহার ও দুর্নীতি। আন্দোলনের ডাক দিয়ে যদি ৫০ জন আহতকে মাঠে নেওয়া হয় এবং বরাদ্দ আসে ৫০ হাজার টাকা। তাহলে দেখা যায় প্রতিজনকে মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা কেউ কেউ আত্মসাৎ করে। এই ধরনের দুর্নীতির ফলে প্রকৃত আহতরা ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং আন্দোলনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।