জলবায়ু পরিবর্তনের মাশুল দিতে হবে আগামীর শিশুদেরও

ঘূর্ণিঝড়ে বাস্তুহারা এক মা ও শিশু। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা থেকে তোলা ছবিটি
ঘূর্ণিঝড়ে বাস্তুহারা এক মা ও শিশু। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা থেকে তোলা ছবিটি  © শেখ শাকিল হোসেন

ঘটনা ১: সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের রিয়াজ (১১) নামে এক শিশুর পরিবারের বসবাস। গেল বছর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় 'আমফান' এর শিকার পরিবারটি। ঘূর্ণিঝড় আমফানের আঘাতে তাদের বাসস্থান, ফসলি জমিসহ সবই নদীতে ভেসে যায়৷ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে রিয়াজের পরিবার। দুর্যোগের শিকার পরিবারটি একেবারে কর্মহীন হয়ে পড়ে৷ এমতাবস্থায় শিশুর বাবা-মা তাকে ইট-ভাটার কাজে পাঠিয়ে দেয়। অল্প বয়সে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে কিছুদিন পরই রিয়াজ অসুস্থ হয়ে পরে। জানা গেছে, রিয়াজের মতো হাজারো শিশুকে অল্প বয়সে কর্মক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয় বাবা-মা। এভাবে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে অনেক শিশু মারাও যায়।

ঘটনা ২: সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার অন্তর্গত প্রতাপনগর ইউনিয়নে পরিবারের সাথে বসবাস করেন রোকেয়া (১৩) নামের একজন শিশু। চলতি বছর উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রোকেয়াদের পরিবার। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বাড়ি-ঘর সব হারিয়ে স্থানচ্যুত হয়ে পড়ে পরিবারটি। ঘূর্ণিঝড় 'ইয়াস' এর পর নতুন করে জীবন সাজাতে তাই খুলনা শহরে পাড়ি জমায় রোকেয়ার পরিবার। সেখানে গিয়ে কিছুদিন পরেই বাল্যবিয়ে হয় রোকেয়ার।

উপরের ঘটনা দুটি থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় দেশের উপকূলে বসবাসরত শিশুদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার ভয়াবহ প্রভাব কতটা খতরনাক ও গভীর। দেশে ক্রমশ জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিকর প্রভাব উপকূল এলাকার শিশুদের জীবনকে এভাবেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয় উপকূল এলাকার মানুষের জনজীবন।মূলত মানবসৃষ্ট কারণেই জলবায়ুর আকস্মিক বিপর্যয়ের ফলে প্রতিবছর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন নিয়মিত হয়ে উঠছে। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে শিশুদের উপর। প্রায়শই ঘূর্ণিঝড়, বন্যার ফলে শিশুদের শৈশব বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেই সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্কুল-কলেজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পড়াশোনার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয় লাখ লাখ কোমলমতি শিশু। ফলে এসব শিশুদের ভবিষ্যৎ চরম ঝুঁকিতেই থেকে যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শিশুদের উপর বহুমাত্রিক প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর সৃষ্ট বড় বড় ঘূর্ণিঝড়গুলো উপকূল দিয়ে অতিক্রম করায় সম্বলহীন হচ্ছে অনেক পরিবার। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি বিলীন, জীবন-জীবিকা সংকটসহ নানান প্রতিকূলতার ফলে উপকূলের শিশুদের শিক্ষায় বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষয়ক্ষতি, ইন্টারনেটের অপ্রতুলতা, দক্ষ শিক্ষকের অভাব, শিক্ষার উপকরণ সমস্যা, সুপেয় পানির অভাব, দারিদ্রতা, পুষ্টিহীনতা, স্বাস্থ্যসেবার অভাবসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত উপকূলের শিশুরা৷

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, মূলত মানবসৃষ্ট কারণেই জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে৷ নির্বিচারে বন উজাড়, গাছপালা কর্তন, নদী ভরাটসহ নানান কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েই চলেছে। ফলে দেশে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে। আর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চল। বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে এসব অঞ্চলে বসবাসরত শিশুদের ভবিষ্যৎ। উপকূলের শিশুদের জীবন বাঁচাতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমন চরম মাত্রায় হ্রাস করতে হবে। সেই সাথে অঞ্চলভেদ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে আরও সম্পদ ও উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচি হাতে নিলে জলবায়ু পরিবর্তন ও শিশুদের জীবন ঝুঁকি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হবে।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়া অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শিশুর বসবাস শক্তিশালী নদীপ্রবাহের মধ্যে ও এগুলোকে ঘিরে। উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী আরও ৪৫ লাখ শিশু নিয়মিত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। আরও ৩০ লাখ শিশুর বসবাস দূরবর্তী দ্বীপগুলোতে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ৬০ লাখ জলবায়ুজনিত অভিবাসী রয়েছে, যে সংখ্যাটি ২০৫০ সালের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত পরিবার গুলোতে বাবা-মা তাদের সন্তানদের যথাযথভাবে সকল চাহিদা পূরণ করতে ও শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে না। অধিকাংশ বাবা-মাকে শিশুদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। এছাড়া শিক্ষার যথাযথ পরিবেশের অভাবেও শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পড়াশোনার অর্থ ব্যয় করতে না পারায় অনেক পরিবার শিশুদের কর্মক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন শিশুশ্রম বাড়ছে অন্যদিকে শিশুদের জীবনে নেমে আসছে ভয়াবহ বিপর্যয়। এছাড়া মেয়েদের বাল্য বিয়ে দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। এসব কারণে উপকূল থেকে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে না, যা সমাজ ও দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফী বিভাগের চেয়ারম্যান ও সমুদ্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন মুন্না দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে ধরনের ভয়াবহতা বা ঝুঁকি তৈরি হয় তার মধ্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পরে শিশুরা৷ বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলের শিশুদের মন-মানসিকতার উপর বিরাট প্রভাব ফেলে। এসব শিশুরা নানাভাবে বঞ্চিত, অবহেলিত ও একধরনের আশঙ্কাগ্রস্থ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা যদি আরো বেশি হয় তাহলে বৃহত্তর সমাজে এর প্রভাব আরো উদ্বেগজনক হয়ে উঠবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা এড়াতে স্থানভেদে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। এসবের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে উপকূলীয় বিভিন্ন অঞ্চলে। একটি অঞ্চল বা এলাকা জলবায়ুগত কোন ধরনের প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এগুলো সর্বপ্রথম চিহ্নিত করতে হবে৷ কারণ একেক অঞ্চলে একেকরকম ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে৷ এসব ঝুঁকির কারণ চিহ্নিত করে স্থানভেদে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলের স্থানীয় মানুষের মতামত এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতকে সমন্বয় করে কর্মসূচি হাতে নিলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব।


সর্বশেষ সংবাদ