দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণের আভাস
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২১, ০৮:৫৫ AM , আপডেট: ২২ আগস্ট ২০২১, ০৮:৫৫ AM
গত মাসে দেশে করোনা সংক্রমণের তুঙ্গে থাকা অবস্থা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে। চলতি মাসের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এই ভাইরাসের চলমান ঢেউ কমে আসার ইঙ্গিতই মিলছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরাও বলছেন, করোনার সংক্রমণ আরও কমে আসতে পারে সামনের দিনগুলোতে, তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে সংক্রমণ যেকোনো সময়ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
জুলাইয়ে দেশের প্রধান হাসপাতালগুলো সারাদেশ থেকে আসা রোগীদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে। তবে সংক্রমণ কমে আসায় বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে গত মাসের তুলনায় রোগী ভর্তি হচ্ছে কম। সেই সঙ্গে আইসিইউতে ভর্তি করানো রোগীদের সংখ্যাও আগের তুলনায় কমে এসেছে। এসব কারণে দেশের হাসপাতালগুলোতে ফাঁকা থাকা সাধারণ শয্যা ও আইসিইউ শয্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশে করোনা চিকিৎসায় নির্ধারিত প্রায় ১৭ হাজার শয্যার ৫৯ দশমিক ৬৯ শতাংশই খালি পড়ে আছে। এছাড়া করোনা রোগীদের জন্য থাকা এক হাজার ৩৩০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে খালি রয়েছে ৩৩ দশমিক ০৮ শতাংশ।
সাধারণত দৈনিক মৃত্যু, শনাক্ত ও শনাক্তের হার- এই সূচকগুলোকে মাথায় রেখেই করোনা পরিস্থিতিকে বিশ্নেষণ করা হয়। চলতি আগস্টে এ তিনটি সূচকেই উন্নতির ধারা দেখা গেছে। জুলাইয়ে যেখানে এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত পাওয়া গিয়েছিল ১৬ হাজারের বেশি, সেখানে সর্বশেষ এক দিনে চার হাজারের কম নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। টানা ১৫ দিন দৈনিক দুই শতাধিক মানুষ করোনা সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত হলেও গত কয়েকদিন ধরে তা নেমে এসেছে দুইশর নিচে।
গত এক দিনে মৃত্যু হয়েছে ১২০ জনের। ৫২ দিন আগে গত ৩০ জুন এর চেয়ে কম ১১৫ জনের মৃত্যুর খবর জানা গিয়েছিল। এছাড়া নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হারেও ভাটার টান আগস্টজুড়ে। চলতি মাসের প্রথম দিন যেখানে ৩০ ছুঁইছুঁই সংক্রমণ হার দেখা গিয়েছিল, সেখানে গত একদিনে তা ১৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, পুরো জুলাইয়ে করোনা দেশে তাণ্ডব চালালেও চলতি মাসের শুরু থেকে কমতে শুরু করে নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার। দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি বুঝতে এই হারটিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। জুলাইয়ে দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে আগস্টে তা আছে কমার ধারাতে। চলতি মাসে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ২১ দিনের মধ্যে ১৯ দিনই আগের দিনের তুলনায় কমেছে শনাক্তের হার। মাত্র দুই দিন আগের দিনের চেয়ে শনাক্তের হার পাওয়া গেছে বেশি।
তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ১ আগস্ট থেকে টানা ১৩ দিন ধরে কমে গত ১৩ আগস্ট হারটি নেমে আসে ২০ দশমিক ২৫ শতাংশে। পরে ১৪ আগস্ট আগের দিনের চেয়ে বেড়ে ২০ দশমিক ৬৬ শতাংশ হারে রোগী পাওয়া গেছে। পরদিন ১৫ আগস্ট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হারটি কমে ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ হলেও ১৬ আগস্ট বেড়ে ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ হয়। এরপর থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন আগের দিনের তুলনায় শনাক্তের হার পাওয়া গেছে কম। এর মধ্যে গত ১৭ আগস্ট শনাক্তের হার ২০ শতাংশের নিচে নেমে আসে, ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। এছাড়া ১৮ আগস্ট ১৭ দশমিক ৬৭, ১৯ আগস্ট ১৭ দশমিক ৬৪, ২০ আগস্ট ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং গতকাল শনিবার ১৭ শতাংশের নিচে নেমে ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ হারে রোগী শনাক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে এখন মোট শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৯১ শতাংশ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণ হারটি আরও কমে আসার কথা। বর্তমানে যে কমার ধারাটি রয়েছে, সেটিই বহাল থাকবে। তবে ফেব্রুয়ারি বা মার্চ থেকে দেশে আবার সংক্রমণ তীব্র হবে বলে ধারণা করছি। কমার ধারায় থাকলেও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলতে হবে। টিকা গত বছর ছিল না, এই বছর আছে। টিকার আওতা বাড়াতে পারলে পরবর্তী বছরে সেটির ভালো ফল আমরা পাবো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কারণে সংক্রমণের এমন তারতম্য হতে পারে। শীতের সময় ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অনেক ভাইরাসই আমাদের আক্রমণ করে। করোনা সংক্রমণ বাড়া বা কমায় এ বিষয়টির একটি প্রভাব আছে বলে আমার মনে হয়।
দৈনিক শনাক্ত এক মাস ও মৃত্যু দেড় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দৈনিক শনাক্ত কম ছিল। আগের বছরের ডিসেম্বর থেকে সংক্রমণ কমার নিম্নমুখী ধারাটি এ বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এর মাঝেই গত ৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক শনাক্ত পাওয়া যায় মাত্র ২৯১ জন। বাকি দিনগুলোতেও দেশে প্রতিদিন করোনা রোগী শনাক্তের পরিমাণ ছিল এক হাজারেরও কম। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। এর ধারাবাহিকতায় গত ৭ এপ্রিল সাত হাজার ৬২৬ জন শনাক্তের খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে দৈনিক শনাক্তের ঊর্ধ্বমুখী ধারাটিও খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কমতে কমতে একপর্যায়ে সেটি গত ১৬ মে নেমে আসে ৩৬৩ জনে। করোনা রোগী বৃদ্ধির মূল ধারাটি শুরু হয় এর পর থেকেই।
১২ জুলাই আক্রান্তের সংখ্যাটি ১৩ হাজার ৭৬৮ জনে পৌঁছায়। গত ২৮ জুলাই দেশের ইতিহাসে এক দিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জনের শরীরে করোনা ধরা পড়ে। এরপর থেকে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যাটি উঠানামার মধ্যে থাকলেও গ্রাফটি ছিল নিম্নমুখী। আগস্টজুড়েই দৈনিক শনাক্তের এ নিম্নমুখী ধারাটিই দেখা গেছে। এ ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ গত এক দিনে এক মাস পর চার হাজারের নিচে নামল দৈনিক শনাক্ত। গত চব্বিশ ঘণ্টায় সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করে তিন হাজার ৯৯১ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে।
দৈনিক শনাক্ত ও শনাক্তের হারের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে কমেছে দৈনিক মৃত্যুও। চলতি বছরের জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনিক মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এর পর থেকে এ সংখ্যাটিও দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। গত ২৫ জুন দৈনিক মৃত্যু শতক অতিক্রম করে। এর পর থেকে লাফিয়ে বাড়তে থাকে দৈনিক মৃত্যু। গত ৭ জুলাই প্রথমবারের মতো দেশে এক দিনে দুইশর বেশি মানুষ যুক্ত হন মৃতের তালিকায়। এ পরিস্থিতি চলতে থাকে জুলাইজুড়েই। এ সময় করোনায় আক্রান্ত হয়ে ও উপসর্গ নিয়ে প্রচুর মৃত্যু হয় দেশের নানা প্রান্তে।
চলতি মাসের ৫ ও ১০ তারিখে এক দিনে করোনা সংক্রমিত হয়ে সর্বোচ্চ ২৬৪ জন করে প্রাণ হারান। ১১ আগস্ট থেকে কমতে থাকে দৈনিক মৃত্যু। ২৫ জুলাই ২৫ থেকে টানা ১৫ দিন দৈনিক দুই শতাধিক মৃত্যু দেখার পর গত ১৩ আগস্ট দৈনিক মৃত্যু নেমে আসে ১৯৭ জনে। এরপর থেকে দৈনিক শনাক্ত ও শনাক্তের হারের মতো নিম্নমুখী ধারাতেই ছিল দৈনিক মৃত্যু। এ ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ গত এক দিনে ১২০ জন প্রাণ হারিয়েছেন করোনা সংক্রমিত হয়ে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দৈনিক এ সংখ্যাটি গত ৫২ দিনের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর চেয়ে কম ১১৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল গত ৩০ জুন।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, যে কোনো সময়ই সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে, এটি আগে থেকে বলা যায় না। পৃথিবীর অনেক দেশেই সংক্রমণ বাড়ছে। জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাবে সংক্রমণ পরিস্থিতি আবার খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র রাস্তা স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং টিকা নেওয়া।