করোনা যুদ্ধে জাবির সাবেক শিক্ষার্থী আমিনুল

করোনা যুদ্ধে হার না মানা এক সৈনিকের নাম আমিনুল ইসলাম। যেখানে স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত অনেকেই গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন, সেখানে ব্যতিক্রম আমিনুল। তিনি দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বিনা পারিশ্রমিকে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণে ডাক্তার ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

আমিনুল ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ৩৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমানে তিনি বায়ো-মেডিসিন গবেষক এবং মেডিনোভাতে বায়োকেমিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন।

জানা যায়, তরুণ এই গবেষক ইতোমধ্যে কোন প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

দেশের স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, করোনা শনাক্তকরণে অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা এবং ঝুঁকি রয়েছে। WHO এর মতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা। কিন্তু মেডিকেল কলেজগুলোতে যে সকল পিপিই, মাস্ক, সুরক্ষা চশমা, জুতার কভার দেওয়া হয়েছে সবই অত্যন্ত নিম্নমানের। তাই করোনা শনাক্তকরণে বিপদ রয়েছে বলা চলে এবং স্বেচ্ছাসেবক বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট, জেনেটিক ইন্জিনিয়ার, চিকিৎসক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টরাও ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন।

বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বাস্থ্যকর্মীরা কিভাবে কাজ করছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহ থেকে চূড়ান্ত ফলাফল দেওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া যদি আমরা পাঁচ ভাগে ভাগ করি। তবে প্রথম তিন ধাপ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন নমুনা সংগ্রহ, নমুনা ল্যাবে আনার পর রোগীর ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণ ও নমুনা প্রক্রিয়াকরণ।

এই সময় তিনি স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, যে নমুনা সংগ্রহ করবে তার পিপিই, মাস্ক, সুরক্ষা চশমা, জুতার কাভার ও হাতের গ্লভস্ থাকা জরুরী এবং প্রতিবার নমুনা সংগ্রহ করার পর গ্লভস্ জীবাণুমুক্ত করে খুলে নতুন গ্লভস্ পরতে হবে। কিন্তু অনেক জায়গায় এগুলো তে নজর দিচ্ছেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। নমুনা ল্যাবে আসার পর নমুনা সংগ্রহের ব্যাগ বা প্যাকেট ভালভাবে জীবাণু মুক্ত করা লাগবে। করোনা লক্ষণ থাকা ব্যক্তির তথ্য লিপিবদ্ধ করার সময় প্রত্যেক নমুনা বের করাতে হয় নমুনা সংগ্রহকারী ব্যাগ বা প্যাকেট থেকে। তাই যে নমুনা বের করবে সে তার হাত জীবাণু মুক্তকরণ ছাড়া কলম বা খাতা স্পর্শ করবেনা। শুধুমাত্র লিপিবদ্ধের জন্য আলাদা একজন হলে ভাল হয়, যে শুধু এই কাজই করবে।

তিনি স্বাস্থ্যকর্মীদের বিভিন্ন ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে বলেন, নমুনা প্রক্রিয়াকরণের সময় দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের সেলাইন পানি মিশ্রিত টিউবে নমুনা আসছে। যেগুলো থেকে নমুনা নেওয়া যেমন কষ্টকর তেমনই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ নমুনা সংগ্রহের টিউব বেশি লম্বা হলে পিপেট ঢুকেনা এর ভিতর দিয়ে। তাই নমুনা নেওয়া যায় না সরাসরি। নমুনা বড় টিউব থেকে আবার খালি ছোট টিউবে নিতে হয়। কারণ নমুনা ঝাঁকিয়ে এবং যন্ত্রে ঘুরিয়ে তা থেকে নমুনা ছোট পিসিআর ওয়েলে নিতে হয়। তখন বড় টিউব থেকে ছোট খালি টিউবে নমুনা খুবই সতর্কতার সাথে ঢেলে নিতে হয়। আর এ সময় খুব সাবধানী না হলে নমুনা হাতে লাগতে পারে এবং যে নমুনা প্রক্রিয়াকরণ করবে সে আক্রান্ত হতে পারে। তাই সবচেয়ে ভাল ভিটিএম বা ভাইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়াতে নমুনা সংগ্রহ করা যেটাতে সেলাইন পানি মিশ্রিত টিউবের চেয়ে ঝুঁকি কম, ভাইরাসের কার্যক্ষমতা ভাল থাকে।

আমিনুল হতাশা ব্যাক্ত করে বলেন, সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো করোনা শনাক্তকরণের জন্য বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যারা পড়াশোনা করা এবং এই পরীক্ষার সব কিছু যারা জানে তাদের পরিবর্তে ডাক্তারদের এই কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আবার মজার বিষয় হচ্ছে প্রায় সব ডাক্তারই আরটি-পিসিআর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। তাহলে ডাক্তাররা কিভাবে এ কাজ করছে প্রশ্ন হতে পারে।

এমন অবস্থায় কি করণীয়? এমন প্রশ্নে তরুণ এই গবেষক জানান, যাতে ডাক্তার এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা যাতে সঠিকভাবে কাজগুলো সম্পাদন করতে পারে এই জন্য আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তাদেরকে আরটি-পিসিআর শিখানো হচ্ছে এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে করোনা শনাক্তকরণের জন্য কিভাবে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়। যেমন পিপিই জুতার কাভারে সাথে এবং হাতের গ্লাভসের সাথে কিভাবে মিলিয়ে পড়তে হয়, কোনটা আগে পরে পড়তে হয় খুলতে হয়।

আমিনুল ইসলামের দাবি, এভাবে নতুন করে ডাক্তারদের না শিখিয়ে যারা শিখাচ্ছেন তারাই কিন্তু কাজটা করতে পারেন। যদি সরকার সে ব্যবস্থা করে।

তিনি বলেন, যারা স্বেচ্ছায় পারিশ্রমিক ছাড়া ডাক্তার টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তারা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়েছেন এবং সরকারি সঠিক মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যে তারা কাজ করবে তা করতে পারছেন না। আবার এই স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষকদের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও মনে হয় না কিছু জানে। আর করোনা শনাক্তকরণের সবকিছু শিখতে ডাক্তারদের ২-৩ মাস প্রশিক্ষণ দরকার সেখানে ১-২ সপ্তাহে শিখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই ডাক্তার এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা থাকলেও যথাযথ প্রশিক্ষনের অভাবে ভুল বেশি হওয়া স্বাভাবিক। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনার শনাক্তকরণে ফলাফল ঝামেলা তারই প্রমাণ। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো স্বল্প প্রশিক্ষনে কাজ শুরু করলে ডাক্তার ও টেকনোলজিস্টরা নিজেরাই করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। যে বিষয় গুলো বলা হলো যেগুলো উপর মহলে যাচ্ছেনা। কারন স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট এবং জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং এর কেউ নেই এসব বিষয়ে কথা বলার মতো।

তিনি মলিকুলার বায়োলজিস্টদের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, করোনা প্রতিরোধে মলিকুলার বায়োলজিস্টদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার সক্ষমতা থাকার পরও গত ১৮ এপ্রিল গঠিত ১৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় পরামর্শক কমিটিতে বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট কাউকে রাখা হয়নি। সরকারি সহযোগিতা পেলে ভিটিএম তৈরি এবং করোনা ভাইরাসে জিনোম সিকোয়েন্স করে প্রয়োজনীয় টেস্ট কিট তৈরির কাজে বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্টরা কাজ করতে পারবে বলে আমি মনে করি।


সর্বশেষ সংবাদ