করোনা সংকটে হাসপাতালে অক্সিজেন ঘাটতি

শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবস্থা জটিল হলে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দিতে হয়। সরকারি হিসাব বলছে, রোগী সামলাতে হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সিলিন্ডার যা দরকার, আছে তার অর্ধেক। ঘাটতি আছে আনুষঙ্গিক সরঞ্জামেরও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থায় অক্সিজেন সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

করোনা চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে ১৯টি এবং দেশের ৮টি বিভাগে আরও ৬৪টি হাসপাতাল বাছাই করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, রাজধানীর বাইরে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ৩ হাজার ২০০টি এবং আনুষঙ্গিক সামগ্রী (অক্সিজেন মাস্ক, ফ্লোমিটার, চাবি, ট্রলি) আছে ২ হাজার ৭৩৯ সেট। রোগীর চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন সিলিন্ডার আরও দরকার ৩ হাজার ৪৫টি এবং আনুষঙ্গিক সামগ্রী ৩ হাজার ১৮৯ সেট।

সরকারি হিসাবে রাজধানীর জন্য আরও কত অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার, তার উল্লেখ নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অন্যান্য হাসপাতালের মতো রাজধানীতেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঘাটতি রয়েছে।

করোনা রোগীদের অক্সিজেনের উৎস ও সরবরাহের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশিকা প্রকাশ করে ৪ এপ্রিল। তাতে বলা হয়েছে, সব মারাত্মক ও জটিল করোনা রোগীকে অক্সিজেন দিতে হবে। ১০০ জন আক্রান্তের মধ্যে এ রকম রোগী থাকেন কমপক্ষে ২০ জন।

দেশে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাও। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে চার হাজার ছাড়িয়েছে। রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়টি সামনে চলে আসছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই জীবনদায়ী ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে।

রোগীদের অক্সিজেন নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকাটি তৈরি করা হয়েছে হাসপাতালের ব্যবস্থাপক, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী চিকিৎসক, ক্রয় কর্মকর্তা, পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বায়োমেডিকেল প্রকৌশলী ও হাসপাতাল প্রকৌশলীদের জন্য। এতে অক্সিজেনের চাহিদা নিরূপণ করা, অক্সিজেনের উৎস চিহ্নিত করার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া আছে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, কোভিড–১৯–এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে মারাত্মক ও জটিল রোগীদের চিকিৎসা হবে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। এখানে সবচেয়ে অসুস্থ রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর (কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র) রাখতে হবে, থাকবে পালস অক্সিমিটারসহ অন্যান্য সামগ্রী।

কৃত্রিম অক্সিজেন কেন

কোভিড–১৯ শ্বাসতন্ত্রের রোগ। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন তিনি নিতে পারেন না। রোগীর অবস্থা জটিল হলে অক্সিজেন দিতে হয়।

বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘মানুষের রক্তে অক্সিজেন দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। পালস অক্সিমিটার দিয়ে সহজে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপা যায়। যখনই প্রয়োজনের চেয়ে কম অক্সিজেন ধরা পড়ে, তখনই অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হয়।’

হাসপাতালে ও ক্লিনিকে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকে। যাঁরা দীর্ঘদিন শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভুগছেন এমন সামর্থ্যবানেরা বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখেন।

তবে সিলিন্ডারে অক্সিজেন ব্যবহারের জন্য একটি মাস্ক দরকার হয়। মাস্ক ও সিলিন্ডারের সঙ্গে থাকে ফ্লোমিটার, এর মাধ্যমে কী পরিমাণ অক্সিজেন যাচ্ছে, তা মাপা হয়।

সিলিন্ডার ছাড়াও কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে বেশ কিছু হাসপাতালে। একটি অভিন্ন উৎস থেকে রোগীর শয্যা পর্যন্ত নল দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।

রাজধানীর বাইরের পরিস্থিতি

সরকার রাজধানীর বাইরে সারা দেশে কোভিড–১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৬৪টি হাসপাতাল ঠিক করেছে। এসব হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ পরিস্থিতি সম্প্রতি মূল্যায়ন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিটি বিভাগ, প্রতিটি জেলা এবং প্রতিটি নির্দিষ্ট হাসপাতাল ধরে ওই হিসাব করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, প্রতিটি হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রীর ঘাটতি আছে।

ওই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, রংপুর বিভাগের কোভিড–১৯ রোগীদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে মাত্র ৮২টি। সবচেয়ে বেশি আছে খুলনা বিভাগে, ৭০৬টি। রাজধানীর নির্দিষ্ট হাসপাতালগুলো বাদ দিলে ঢাকা বিভাগে আছে ৬৪৯টি অক্সিজেন সিলিন্ডার।

কোন বিভাগে কতটি বাড়তি সিলিন্ডার দরকার হতে পারে, তারও একটি হিসাব করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি বাড়তি ৫৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার সিলেট বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে।

একটি বিভাগের কোভিড–১৯ বিষয়ক পরামর্শক বলেন, সরকার অক্সিজেন সিলিন্ডারের সঙ্গে থাকা আনুষঙ্গিক সামগ্রীর সেট আছে বলে যে হিসাব তৈরি করেছে, তা কাগজে–কলমে। বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি বলেন, অনেক হাসপাতালে সিলিন্ডার থাকলেও মাস্ক নেই, অথবা ফ্লোমিটার নেই। এমনও হয়তো দেখা যাবে, প্রয়োজনের সময় সিলিন্ডার খোলার চাবি বা বয়ে আনার ট্রলি পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়মিত ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়।

রাজধানীর পরিস্থিতি

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, আপাতত নির্ধারিত রাজধানীর ১৯টি হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ২ হাজার ৫৮৩টি। এসব হাসপাতালের ১০টিতে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। বাকি আটটিতে শুধু সিলিন্ডার আছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ আছে শুধু আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটার ও ডায়ালাইসিস কেন্দ্রে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সিলিন্ডার আছে ৩৫০টি। কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে আছে ১২৩টি। আর মহানগর হাসপাতালে আছে ৪৮টি অক্সিজেন সিলিন্ডার। এই তিনটি হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থার পাশাপাশি যথাক্রমে ৬২৮টি ও ২৪৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে।

মিরপুর লালকুটি হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ২০টি। কিন্তু সিলিন্ডার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার কোনো ট্রলি নেই বলে সরকারের নথিতে বলা আছে।

সিলিন্ডার নিয়ে সমস্যা

বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘কোভিড–১৯ রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ দরকার। কিন্তু সিলিন্ডারে তা পুরোপুরি সম্ভব নয়। একটি সিলিন্ডারের অক্সিজেন ৪ থেকে ৫ ঘণ্টায় শেষ হয়ে যায়। তখন নতুন সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হয়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলার একজন সিভিল সার্জন বলেছেন, একজন করোনা রোগীর চার–পাঁচ দিন বা তারও বেশি সময় টানা অক্সিজেন সরবরাহের দরকার হয়। কিন্তু অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে সিলিন্ডার ৩–৪ ঘণ্টা পরপর পাল্টাতে হয়। আবার যিনি সিলিন্ডার পাল্টাতে থাকেন, তাঁরও সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।

একটি বিদেশি স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বলেন, একজন রোগীর দিনে ৩ থেকে ৪টি সিলিন্ডার লাগবে। এর অর্থ সিলিন্ডারের সংখ্যার এক–চতুর্থাংশ রোগী তা (৩ হাজার ২০০ সিলিন্ডার ৮০০ রোগীর কাজে আসবে) ব্যবহার করতে পারবে। একটি নির্দিষ্টসংখ্যক সিলিন্ডার অক্সিজেন ভরে আনার জন্য রাস্তায় থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার চাইলেও কোভিড–১৯–এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে অল্প সময়ে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ অবকাঠামো গড়ে তোলা কঠিন হবে। পরিকল্পনা করে ফেব্রুয়ারি বা মার্চের শুরুতে উদ্যোগ নিলে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হতো। এ পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত, সরকারি–বেসকারি যেসব হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা আছে এবং রোগী কম আছে, সেগুলোকে কোভিড–১৯ রোগের আওতায় নিয়ে আসা। এসব হাসপাতালের রোগীদের দ্রুত সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা।

সিলিন্ডার পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও চিন্তিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল শাখা) আমিনুল হাসান বলেন, ‘অল্প সময়ে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই জেলা কমিটিগুলোকে বলা হয়েছে আশপাশে বন্ধ থাকা বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করতে। আর পারলে সিলিন্ডার কিনে নিতেও বলা হয়েছে।’ (সূত্র: প্রথম আলো)


সর্বশেষ সংবাদ