পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ ধরনের আর্থিক অনিয়ম, ইউজিসির সতকর্তা

ইউজিসি
ইউজিসি  © লোগো

দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ২৪ ধরনের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। ভালোমানের ও বড় বাড়িকে খারাপ এবং ছোট দেখিয়ে কম ভাড়া আদায় করা হয়। নিয়ম না থাকা সত্ত্বেও পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের বিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন আয় বাজেটে দেখানো হয় না। অনুমোদন ছাড়া এবং বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করা হয়।

এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয় এবং টেন্ডার ছাড়া কেনাকাটা এবং পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। সব মিলে অনেকটা বেপরোয়াভাবেই শিক্ষক-কর্মচারীদের অবৈধ উপায়ে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়। এমনি নানান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সতর্ক করে পরিপত্র জারি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব আইনে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। কিন্তু কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি ও সাধারণ আর্থিক বিধিবিধান লঙ্ঘন করছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পরিপত্র জারি করা হয়েছে। প্রস্তাবিত কয়েকটিসহ দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৭টি। জুন মাসে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক বছরের বাজেট তৈরি হয়। মূলত এটিকে সামনে রেখে ইউজিসির হিসাব বিভাগ থেকে ৩৪ দফা নির্দেশনা সংবলিত পরিপত্র পাঠানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিতে কয়েকজন ভিসি প্রধান ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেন। তারা এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের সরকার স্পর্শ করতে পারবে না- এমন কথাও প্রকাশ্যে বলে থাকেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সৎ কর্মকর্তারা তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ভয় পান। অনেকে সেসব মুখ বুঝে সহ্য করেন। কেউ কেউ আবার অন্যায়ের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। আর অন্যরা অন্যায়ের সহযোগী হন।

সম্প্রতি একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দুর্নীতির প্রতিবাদে এক ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার পদত্যাগ করেছেন বলে ইউজিসি সূত্র জানায়।

ইউজিসির পরিপত্রে বলা হয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার বা ডরমেটরিতে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি বিলের ব্যাপারে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পর্যবেক্ষণ আছে। কমিটির অষ্টম বৈঠকে এ নিয়ে আপত্তি দেওয়া হয়েছে। উল্লিখিত জনবলকে ইতঃপূর্বে দেওয়া বর্গফুট হিসাবে বা নির্দিষ্ট হারে বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড (নিম্নমানের) দেখিয়ে বা দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। অথচ এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তাই এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রচলিত নিয়মে বাড়ি ভাড়া আদায় করতে হবে। আর সুবিধাভোগীর কাছ থেকে অন্য সব (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস) বিল (প্রকৃত) আদায় করতে হবে। কোনোরূপ ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি সংসদীয় কমিটির উল্লিখিত খাতে আপত্তি অর্থ আদায় করতে হবে। এ ব্যাপারে ১০ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারি করেছে।

ইউজিসির কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুৎপাদনশীল ব্যয়ের বড় একটি খাত হলো ঢাকায় রেস্ট হাউজ বা লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন। উপাচার্যরা ঢাকার বাইরে না যাওয়ার লক্ষ্যে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে এগুলো স্থাপন করেন। অবশ্য পরিপত্রে ইউজিসি রেস্ট হাউজের ব্যাপারে নমনীয়তা প্রকাশ করে বলেছে, এছাড়া লিয়াজোঁ অফিসসহ আর কোনো কিছু রাখা যাবে না।

বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে বলা হয়, এক খাতের অর্থ অন্য খাতে কিংবা মূল খাতের অর্থ অভ্যন্তরীণ কোনো খাতে সমন্বয় করা যাবে না। কমিশনের অনুমতি ছাড়া কোনো খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত ব্যয় করা যাবে না। কোনো খাতে বাড়তি অর্থের দরকার হলে ইউজিসিকে অবহিত করতে হবে। অনুমোদিত জনবলের বাইরে কোনো প্রকার নিয়োগ দেওয়া যাবে না। বিধিবহির্ভূত নিয়োগে ব্যয়ের অর্থের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় না।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তরা অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে উৎসব ও নববর্ষভাতা গ্রহণ করবেন। চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করতে হলে তাকে অঙ্গীকারনামা দিতে হবে-তিনি অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে এসব ভাতা নেবেন না। এ ধরনের জনবলকে চুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে কনসোলিডেট পেমেন্ট ফিক্সেশনের সময় কোনোভাবেই উল্লিখিত দুই ভাতা অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া অ্যাডহক, দৈনিকভিত্তিক বা আউটসোর্সিংয়ে লোকবল নিয়োগ করা যাবে না। আর শূন্যপদে অনুমোদনের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ অনুমোদন সাপেক্ষে নিয়োগ করা যাবে।

এতে আরও বলা হয়, বাজেট সম্মানী দেওয়ার ক্ষেত্রে কেবল হিসাব শাখার জনবলকে বিবেচনা করা যেতে পারে। অন্য কোনো শাখার কেউ পাবেন না। স্বচ্ছতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে যে কোনো ব্যয়ের ভাউচার বা বিল চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে প্রাক-নিরীক্ষা করতে হবে। পুরাতন যানবাহন পুনঃস্থাপন, জমি বা ফ্ল্যাট ক্রয় কিংবা বাড়ি ভাড়া, পেনশন-বিধি ও আর্থিক বিষয়ে প্রণীত নীতিমালাসহ অন্যান্য অর্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুমোদনের জন্য ইউজিসিতে পাঠাতে হবে। অবসর, পদত্যাগ ও মৃত্যুর কারণে সৃষ্ট শূন্যপদে সংশ্লিষ্ট বছরের মধ্যে নিয়োগ বা পদোন্নতি দেওয়া যাবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের আগের কোনো শূন্যপদে বা নতুন পদে নিয়োগে অবশ্যই ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদন ছাড়া নতুন অনুষদ, বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও কেন্দ্র খোলা যাবে না। প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে। বাকি ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করতে হবে। আর এ আয় নিজস্ব আয়ের মধ্যে অবশ্যই দেখাতে হবে।

এছাড়া ভর্তি, টিউশন, পরীক্ষা, ল্যাব টেস্ট, বিশেষ কোর্স, বেতন থেকে কর্তনাদি, সম্পত্তি থেকে লব্ধ অর্থ ইত্যাদি অবশ্যই নিজস্ব আয় হিসাবে বাজেটে দেখাতে হবে। বিভিন্ন প্রকার ব্যয়ে প্রযোজ্য হারে ভ্যাট ও কর আদায় করতে হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বভাতা বেতনের ১০ শতাংশ বা দেড় হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম সেটি দেওয়া যাবে। অগ্রিম দেওয়া অর্থ সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। বিল-বেতনভাতা ইএফটির (ব্যাংক) মাধ্যমে দিতে হবে।

বেতনভাতা দেওয়ার ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল এবং এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। ১৯৭৪ সালের সরকারি কর্মচারী আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ জনবলের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। এ কারণে এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব সংবিধি দ্বারা অবসরের বয়স নির্ধারিত করবে। পাশাপাশি তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে।

এছাড়া পেনশন খাতে অর্থ স্থানান্তর বা ব্যয় করা হলে অননুমোদিত হিসাবে তা গণ্য হবে, এর দায়ভার ইউজিসি নেবে না। আর যখন যার অবসরের দিন আসবে, তখন তিনি অবসরে যাবেন। কোনো প্রকার সেশন ব্যানিফিট দেওয়া যাবে না।

জানা গেছে, গত কয়েক মাসে ইউজিসির বাজেট পরীক্ষক দল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। তখন উদঘাটিত আর্থিক অনিয়ম ও এ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ বাজেটের নির্দেশনার সঙ্গে সংযুক্ত করে উল্লিখিত পরিপত্রের সঙ্গে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে ২০ জুনের মধ্যে অবহিত করতে বলা হয়।

এছাড়া সিনেট বা সিন্ডিকেট-রিজেন্ট বোর্ডে পাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ব্যয়ের বাস্তব পরিকল্পনা জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়। পাশাপাশি এর আগে খসড়া বাজেট তৈরির পর বিস্তারিত ১০ জুনের মধ্যে ইউজিসিকে অবহিত করার অনুরোধ করা হয়।

পরিপত্রে আরও পাঁচ ধরনের প্রতিবেদন ও তথ্য চেয়ে বলা হয়-অর্থবছরের পরবর্তী ব্যয়ের হিসাব বছরে চারবার (অক্টোবর, জানুয়ারি, এপ্রিল ও জুলাই) ব্যাংক রিকনসিলিয়েশন ও স্টেটমেন্টসহ পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন ইউজিসিতে পাঠাতে হবে। বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা পাঠাতে হবে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে। কেনাকাটায় ২০০৮ সালের ক্রয় আইনসহ (পিপিআর) অন্যান্য বিধি অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। অর্থবছরের শেষের দিকে (মে-জুন) কেনাকাটার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। নিয়মিত ও বিশেষ গবেষণা খাতে পৃথকভাবে অর্থ বরাদ্দ করা হয়।

এ সংক্রান্ত প্রস্তাব ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। ক্যাম্পাস খোলার লক্ষ্যে হল-ভবনাদি সংস্কার ও মেরামতের জন্য যে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তার হিসাব ২৩ মের মধ্যে পাঠাতে হবে। এ অর্থ ব্যয়ে কোনো অনিয়ম ভবিষ্যতে উদঘাটিত হলে সংশ্লিষ্টরা দায়ী থাকবেন। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের পরিচালন ব্যয়ের হিসাব ১০ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তিপূর্বক (রিকনসিলিয়েশন) প্রমাণপত্রসহ ইউজিসিতে পাঠাতে হবে।

ইউজিসি সচিব (চলতি দায়িত্ব) ড. ফেরদৌস জামান বলেন, খসড়া বাজেট পাঠানোসহ উল্লিখিত প্রতিবেদন ও তথ্য পাঠানোর নির্দেশনা অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিপালন করেছে। ১০-১২টি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠায়নি। তাদের তাগিদ দিয়ে ফের চিঠি দেওয়া হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ