‘বেলা চাও’ থেকে বিপ্লবের ফুল, গাইলেন লাকী ও শতাব্দী

নান্দনিক থাম্বনেইল ইমেজটির নকশা করেছেন ইউডা’র চারুকলার শিক্ষার্থী সোহানা তাসনিমা এবং তরিক হাসনাত
নান্দনিক থাম্বনেইল ইমেজটির নকশা করেছেন ইউডা’র চারুকলার শিক্ষার্থী সোহানা তাসনিমা এবং তরিক হাসনাত  © সংগৃহীত

ফ্যাসিবাদ ও শোষণবিরোধী গান হিসেবে দেশ ও ভাষার সীমানাকে অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ইতালির বিখ্যাত গান বেলা চাও (Bella Ciao)। এ পর্যন্ত গানটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় গাওয়া হয়েছে। বিশ্বজুড়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে স্বাধীনতাকামী ও স্বৈরাচারবিরোধীসহ  নানা আন্দোলনে। এবার সেই গানটিই বাংলা ভাষায় গাইলেন গণজাগরণ মঞ্চের স্লোগানকন্যা খ্যাত ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি লাকী আক্তার এবং সঙ্গীতশিল্পী শতাব্দী ভব। 

বিপ্লবের ফুল শিরোনামে গাওয়া এ গানটি ইতালিয়ান মূল গান বেলা চাও থেকে ভাষান্তর করেছেন সঙ্গীতশিল্পী শতাব্দী ভব এবং সংগীতায়োজন করেছেন মুইজ মাহফুজ। স্কোর মিউজিক ল্যাবে এই গানটির রেকর্ডিং হয়। এ ছাড়া গানটির মিক্সিং, মাস্টারিং এবং প্রোগ্রামিং করেছেন রেজোয়ান সাজ্জাদ। আর গানটির মিউজিক ভিডিও এবং সিনেমোটোগ্রাফি করেছেন জাহিদুল ইসলাম সজীব।

ইউটিউবে এ গানের থাম্বনেইলে ব্যবহৃত ইমেজটিও নজরকাড়া। জনপ্রিয় স্প্যানিশ ওয়েব সিরিজ ‘লা কাসা ডি পাপেল’ বা ‘মানি হাইস্ট’-এ ব্যবহৃত সালভাদোর দালির চেহারার আদলে তৈরি মুখোশের সাথে লাকী আক্তার এবং শতাব্দী ভব’র পোট্রেটজুড়ে দিয়ে বিপ্লবের ফুল গানের নান্দনিক থাম্বনেইল ইমেজটির নকশা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) চারুকলার শিক্ষার্থী সোহানা তাসনিমা এবং তরিক হাসনাত। লাকী আক্তার এবং শতাব্দী ভব’র কন্ঠে গাওয়া গানটি গত মার্চের শেষ সপ্তাহে প্রকাশিত হয়। 

বেলা চাও গানটি মূলত ইতালিয়ান ফোক সঙ্গীত। তবে ইতালির গৃহযুদ্ধের সময় এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিশেষ করে ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত একইসাথে ফ্যাসিস্ট ইতালিয়ান সোশ্যাল রিপাবলিক এবং নাৎসি জার্মানদের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া সংঘবদ্ধ সশস্ত্র আন্দোলন পরিচিত হয় পার্টিজান আন্দোলন নামে। এই পার্টিজানদের মধ্যেই বেলা চাও গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।

তবে এ গানের আদি রূপটি আরও পুরনো। বিংশ শতকের শুরুর দিকেই ইতালির নারী কৃষকদের কন্ঠে এ গান শোনা যায়। এ নারী চাষীদের ‘মোন্দিনা’ বলা হতো। তাই বেলা চাও গানটির আদিরূপকে ‘বেলা চাও মোন্দিনা ভার্সন’ নামেও ডাকেন অনেকে। সিংহভাগ ফোক গানের মতোই ‘বেলা চাও’ গানটিরও প্রকৃত গীতিকার ও সুরকারের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ফোকলোরবিদরা মনে করেন, উনিশ শতকে গানটি সুরবদ্ধ হয়। উত্তর ইতালির উপত্যকার ‘মোন্দিনা’ নারীরা প্রতিবাদের অংশ হিসেবে এই গানটি গাইতেন। কঠোর পরিশ্রম, দীর্ঘ কর্মঘন্টা এবং অপেক্ষাকৃত মজুরির প্রতিবাদে তারা দল বেঁধে এই গান গাইতেন। গানটি প্রথম ইতালিতে জনপ্রিয়তা লাভ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। তবে গানটির সুর একই থাকলেও কথাগুলো সে সময় একটু ভিন্ন ছিল। পার্টিজান আন্দোলনের পরিবর্তে সেখানে ছিল পোকামাকড় এবং মশার কামড়ের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন ভোরে উঠে কাজ করতে যাওয়ার কথা, পেছনে লাঠি হাতে জমির মালিকের দাঁড়িয়ে থাকার কথা, পরিশ্রম করতে করতে যৌবন হারিয়ে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার কথা। 

গানটি নিয়ে কথা হয় শতাব্দী ভব এবং লাকী আক্তারের সঙ্গে। যার অনুবাদ প্রসঙ্গে শতাব্দী ভব বলেন, “আমি সাধারণত এমন গান করতে পছন্দ করি যেগুলো মানুষকে জাগ্রত করে, মানুষের কথা বলে। সেই জায়গা থেকেই বিভিন্ন বিখ্যাত গান অনুবাদ করে থাকি। এর আগেও ইংরেজি গান Blowin' in the Wind এবং স্প্যানিশ গান ‘Guantanamera’ এর অনুবাদ করেছিলাম। মূলত অনুবাদের ক্ষেত্রে আমার চেষ্টা থাকে গানের মূল আবেদনটা ঠিক রাখা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় পাঁচ বছর আগে আমি বেলা চাও গানটার বাংলা অনুবাদের কাজ শুরু করি এবং চার বছরের কিছু অধিক সময় প্রয়োজন হয় গানটির অনুবাদ সম্পন্ন করতে।”

লাকী আক্তার বলেন “এই গানটি মূলত একটি বিদ্রোহের গান, যেটি বিভিন্ন লড়াই, সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বাংলা লিরিকে মূল গানের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও এর আবেদনকে অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করেছেন ভবদা। তিনি আমাকে প্রথম যখন লিরিকটা দেখিয়ে বলেন তার সাথে আমি গাইবো কিনা, আমি সাথে সাথে রাজি হই। আমার কাছে বাংলা লিরিকটা খুবই ভালো লেগেছে।”

তিনি বলেন, “আন্দোলন সংগ্রামে সংস্কৃতি অনেক বড় একটি হাতিয়ার। এই গানটি তেমনই। আমার বিশ্বাস আমাদের দেশের তরুণরা গানটি অনেক বেশি পছন্দ করবে।”

বর্তমানে কৃষি আন্দোলনে যুক্ত থাকা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক এই সভাপতি জানান, ছোট বেলা থেকেই প্রচুর গান শোনার অভ্যাস তার। বেশ কিছু গানের লিরিক লেখার পাশাপাশি সুরও করেছেন তিনি। এর মধ্যে তার লেখা ও সুর করা একটি গান এবারে ঈদুল ফিতরে প্রকাশ হতে যাচ্ছে। “নয়া নয়া ফুল” শিরোনামের গানটি একটি নিখাদ ভালবাসার গান। লাকী আক্তারের ইউটিউব চ্যানেল ‘গানের লাকী’তে প্রকাশিত হবে গানটি।

বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে শতাব্দী ভব বলেন, “আমাদের দেশেও অনেক ভালো গান হচ্ছে, ফিল্ম হচ্ছে; কিন্তু সেটি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। বড় কোম্পানিগুলো, সরকার কিংবা মেইনস্ট্রিম মিডিয়া প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করছে না। এছাড়া স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা ক্রমশ আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমরা যে বাঙালি সেটিই আমরা ভুলতে বসেছি। রমনার বটমূলে উদীচীর অনুষ্ঠানে হামলা, ময়মনসিংহে চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলা, লালনের ভাষ্কর্যে হামলা, বলাকা ভাষ্কর্যে হামলা এবং সর্বশেষ আলাউদ্দীন সঙ্গীত অঙ্গনে হামলাসহ ধারাবাহিকভাবেই আমাদের সংস্কৃতির ওপরে অসংখ্য হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য যদি একটি বড় সাংস্কৃতিক বিপ্লব না ঘটে তাহলে সামনে হয়তো খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।” 

এক্ষেত্রে লাকী আক্তার মনে করেন, “একটি দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সেদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও বড় প্রভাব রাখে। আমাদের দেশে এখন চালু আছে ডিজিউটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মত আইন যার থেকে রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক থেকে শুরু করে বাউল শিল্পীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হচ্ছে এমন যেখানে বাউলদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মানুষ বাক স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে, গানের কথার জন্য হামলা মামলা ভোগ করতে হয় শিল্পীকে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনের সাথে সাথে, সংস্কৃতি অঙ্গনেও বৈচিত্র ও ভিন্নমতের পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, শিল্পীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না।”

 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence