বশেমুরবিপ্রবি
বিভাগের চেয়ারম্যান যিনি, ছাত্রও তিনি
- বশেমুরবিপ্রবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৪৩ AM , আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৪৩ AM
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে ২০১৭ পর্যন্ত স্নাতকোত্তর কোর্সের কার্যক্রম ছিল না। কিন্তু সেই কোর্সেরই একমাত্র শিক্ষার্থী হিসেবে সনদ নিয়েছেন ওই বিভাগের চেয়ারপারসন আক্কাছ আলী।
ভর্তি দেখানোর ছয় মাসের মাথায় ক্লাস, পরীক্ষা ও থিসিস শেষ করে সার্টিফিকেট উঠে যায় তার হাতে। তবে তার ক্লাস আর পরীক্ষা কখন, কোথায়, কীভাবে হয়েছে তা জানেন না বিশ্ববিদ্যালয়টির ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের তৎকালীন ডিন শাহজাহান আলী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক শাহজাহান বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, এগুলো ফলস অ্যান্ড ফেব্রিকেটেড। এই ধরনের কোনো কোর্স চালু হওয়া কিংবা পরীক্ষা হওয়ার বিষয়ে আমরা জানতাম না, যেটা আমাদের জানার কথা ছিল।”
আক্কাছ আলীর ভাষ্যমতে যে কয়েকজন শিক্ষক তার ক্লাস-পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের একজন মৌসুমী বালা। ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন তিনি।
আক্কাছ আলীর ট্রান্সক্রিপ্ট ‘যাচাইকারী’ হিসেবে স্বাক্ষর করলেও তার ক্লাস-পরীক্ষার বিষয়ে জানা ছিল না তারও। মৌসুমী বালা বলেন, “আমি সবেমাত্র জয়েন করেছি বিভাগে। আমাকে চেয়ারপারসন যা করতে বলেছেন, তাই করেছি। এর বাইরে কিছু করার ছিল না।”
স্বাক্ষর করার আগে ‘পরীক্ষার খাতাও’ তাকে দেখানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি অবাক হয়েছিলাম, উনি যদি ছাত্র হন তাহলে উনার কাছে খাতা থাকে কীভাবে? তবুও ট্রান্সক্রিপ্টে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছি। এরপরতো আমি চলেও আসছি।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুরের নগরকান্দার ছেলে আক্কাছ আলী বলেন, ”কোর্স চালু ছিল আগে থেকে। তবে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। প্রথম ব্যাচের আমি ভর্তি হয়ে শেষ করেছিলাম, যেহেতু আমার মাস্টার্স করা ছিল না।”
অনার্স পাস করা শিক্ষার্থীরা ২০১৮ ও ২০১৯ সেশন থেকে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হচ্ছেন বলে জানান যৌন নিপীড়নের অভিযোগে বাধ্যতামূলক ছুটিতে থাকা এই শিক্ষক।
যেভাবে তৈরি হল জাল সনদ:
আক্কাছ আলীর সনদ জালিয়াতির বেশ কিছু তথ্য স্পষ্ট হওয়া যায় কীভাবে এই জালিয়াতি করেছেন তিনি। ওই কাগজপত্রে দেখা যায়, ২০১১ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে স্নাতক শেষ করে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে বুয়েটের সিএসই বিভাগের মাস্টার্সে ভর্তি হন আক্কাছ আলী।
বুয়েটের সিএসই বিভাগে ভর্তির শর্ত অনুযায়ী, মাস্টার্স পাস করার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে তিন সেমিস্টারে নূন্যতম ৩৬ ক্রেডিট শেষ করতে হবে। তবে সেটি কিছুতেই পাঁচ সেশন অতিক্রম করবে না, যা বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে।
আক্কাছ আলী এই বিভাগ থেকে ২০১২ ও ২০১৩ সালের এপ্রিল ও অক্টোবর সেমিস্টারসহ মোট চারটি সেমিস্টারে পরীক্ষায় অংশ নেন। এছাড়াও ২০১৪ সালের এপ্রিলে আরও একটি সেমিস্টারে অংশ নেন। শর্ত অনুযায়ী ৩৬ ক্রেডিটের এই সব পরীক্ষায় আক্কাছ আলীর অর্জিত ক্রেডিট ছিল মাত্র ১৮ (৫০ শতাংশ)। বাকি ১৮ ক্রেডিট থিসিসের জন্য বরাদ্ধ থাকলেও আক্কাছ আলী তা করেননি।
এরপরে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সভাপতি হয়ে ২০১৭ সালে সেখানে মাস্টার্সের একমাত্র ছাত্র হিসেবে নিজের আবেদনপত্রে শিক্ষার্থী ও সভাপতির স্বাক্ষর করেন তিনি। এই বিভাগে মাস্টার্স ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তির সেশন হিসেবে ২০১২-১৩ উল্লেখ করেন আক্কাছ।
২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি করা আবেদনপত্রে আক্কাছ আলী হাতে লেখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ৬০ শতাংশ ক্রেডিট গ্রহণ করা হল। ৩৬ ক্রেডিটের মধ্যে ২২ ক্রেডিট গ্রহণ করা হল। বুয়েটে ১৮ ক্রেডিট (৫০ শতাংশ) পাওয়ার পরও তিনি এখানে ২২ ক্রেডিট দেখিয়ে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ত পূরণ করেন।
ছাত্র হিসেবে ভর্তির মাত্র দুই মাসের মধ্যে তিনি ২০১৭ সালের এপ্রিল সেমিস্টারের পরীক্ষায় অংশ নেন। যার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন ও পরীক্ষার খাতা বণ্টন আক্কাছ আলীর গোচরেই করা হয়।
জুন মাসে প্রকাশিত আক্কাছ আলীর মাস্টার্স ট্রান্সক্রিপ্টে চারটি সেমিস্টারের কথা বলা হয়েছে। সেখানে সেমিস্টারের হিসেবে দেখানো হয়েছে বুয়েটের ২০১২ সালের এপ্রিল-অক্টোবর এবং ২০১৩ সালের এপ্রিল সেশন। আর সর্বশেষ সেমিস্টার হিসেবে দেখানো হয়েছে ২০১৭ সালের এপ্রিল।
২০১৭ সালের এপ্রিল সেমিস্টারে মাত্র দুই মাসের মধ্যে ছাত্র হয়ে, পড়াশুনা করে তিনটি কোর্স এবং থিসিসে জিপিএ ৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে (এ+) উত্তীর্ণ হন এই বিভাগীয় প্রধান। তার মোট সিজিপিএ দেখানো হয়েছে ৩ দশমিক ৯২।
আক্কাস আলী বলেন, বুয়েটের ক্রেডিট হিসেবে ৬০ শতাংশ পার করেছিলেন তিনি। থিসিস না করেও কেন ট্রান্সক্রিপ্টে থিসিস লিখেছেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি নিজের মতো করে বসিয়েছি। কারণ এখানে ৬০ শতাংশ পূরণ হতে হবে।”
তার থিসিস সুপারভাইজার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না স্বীকার করে আক্কাছ বলেন, “আমি বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর চাকরির কারণে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারিনি। পাবনায় শিক্ষকতার সময় আমি ভেবেছিলাম বুয়েটের মাস্টার্স কোর্সটি শেষ করব, কিন্তু শিক্ষা ছুটি নেওয়া লাগবে বিধায় আমি আর তা করিনি।”
৫ সেমিস্টারে বুয়েটের ১৮ ক্রেডিটকে ২২ ক্রেডিট দেখানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ”যেহতু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী ৬০ শতাংশ ক্রেডিট ট্রান্সফার করতে হয়ে বিধায় আমিও সেটা করেছি।”
কম সময়ে পড়াশোনা শেষ করা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ”এটা ঠিক আমার পরীক্ষা হতে সময় লেগেছে এক মাসের মতো, তবে আমার কোর্স সুপারভাইজার খুব ভালো মানুষ হওয়ায় আমি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাস করতে পেরেছি।”
সনদ জালিয়াতি বিষয়ে টেলিফোনে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম গোলাম হায়দার বলেন, “এখন ঝামেলার মধ্যে আছি, পরে ফোন করব।” এরপর ফিরতি ফোন আর আসেনি। ফোন করলেও ধরেননি গোলাম হায়দার।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে ফোন করে এবং এসএমএস পাঠিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এই উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগে তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।