১৮ এপ্রিল ২০২৪, ২০:০৪

বুয়েটে পরীক্ষার সব আয়োজন আছে, নেই শুধু পরীক্ষার্থী

পরীক্ষা গ্রহণের জন্য শ্রেণিকক্ষে অপেক্ষা করছেন এক শিক্ষক ও কর্মকর্তা। দুপুরে বুয়েট থেকে তোলা।  © টিডিসি ফটো

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি না ফেরানোর দাবিতে অটল রয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। এর বাইরে আরও পাঁচ দফা দাবিসহ মোট ছয় দফা দাবিতে উচ্চশিক্ষালয়টির ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন অব্যাহত রেখেছেন তারা। এর মধ্যে ঈদ ও পহেলা বৈশাখের ছুটি ঘিরে গত ৪ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল (মঙ্গলবার) পর্যন্ত বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল কার্যক্রম। ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা গ্রহণের সব ধরনের আয়োজন রাখলেও তাতে কোনো সাড়াই দেননি শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) বুয়েটের ১৯ এবং ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা এবং দুপুর ২টায় আলাদাভাবে পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সকালে নির্ধারিত সময়ের আগেই পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র নিয়ে প্রবেশ করেন শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়টির দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তারা অপেক্ষাও করেন। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী না আসায় শিক্ষকরা সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শূন্য উপস্থিতির পরীক্ষার হলগুলো থেকে বেরিয়ে যান বলে নিশ্চিত করেছেন ব্যাচটির শিক্ষার্থীরা। সকালের পরীক্ষায় ১ হাজার ৩০৫ জন শিক্ষার্থীর মাঝে উপস্থিত হননি কোনো শিক্ষার্থী।

একই চিত্র দেখা গেছে দুপুর ২টার পরীক্ষায়ও। নির্ধারিত সময়ের আগেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে হাজির হন শিক্ষকরা। নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট আগে নিয়ম করে বাজানো হয়েছিল সতর্ক ঘণ্টাও। এছাড়াও দুপুর ২ টায়ও বেজেছিল পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাও। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সব আয়োজন থাকলেও ছিলেন না কোনো শিক্ষার্থী। অর্থাৎ যাদের ঘিরে এতো আয়োজন কর্তৃপক্ষের তারাই ছিলেন না এ আয়োজনে। এতে খালি হাতেই আবারও প্রশ্নপত্র নিয়ে ফিরতে হলো বুয়েটের শিক্ষকদের।

যেহেতু আমরা কোর্টের কাছ থেকে আদেশ পাইনি। কাজেই ২০১৯ সালের বিজ্ঞপ্তি ছিল সেটি এখন পর্যন্ত ভ্যালিড আছে বলেই আমরা মনে করি। আর যদি আইনি প্রক্রিয়ায় এমন হয়, বিশ্ববিদ্যালয় হেরে গেল, তাহলেই একমাত্র ক্যাম্পাসে রাজনীতি ফিরবেঅধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খান, উপ উপাচার্য, বুয়েট।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, তারা নিয়ম মেনেই পরীক্ষা আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি এবং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সব ধরনের আয়োজনই তাদের রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করলে তাদের কিছুই করার নেই।

বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হলেও পূর্ব নির্ধারিত রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা গ্রহণের জন্য ক্যাম্পাসে আসতে থাকেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। তবে ক্যাম্পাসে পাওয়া যায়নি শিক্ষার্থীদের। ২-৩ জন যারাই এসেছেন তারাও ঘুরে ফিরে গেছেন পরীক্ষা না দিয়েই।

‘আমি দেখতে এসেছি এখানে কী অবস্থা। আমার বন্ধুরা কেউ পরীক্ষায় অংশ নিতে এসেছে কিনা তাও দেখছি। এখানে কেউই নেই। আমিও পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছি না’— বলছিলেন বুয়েটের ১৯তম ব্যাচের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী।

পরীক্ষা থাকলেও এদিন ক্যাম্পাসে ছিলেন না শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে বুয়েট ক্যাম্পাস থেকে তোলা। ছবি: টিডিসি ফটো।

এর আগে দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খান। তিনি জানিয়েছেন, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ এখন পর্যন্ত তারা পাননি। হাইকোর্টের আদেশ পাওয়ার পর তারা আইনি লড়াইয়ে যাবেন। আইনি উপায়ে শেষ অবধি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান তিনি।

অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খান বলেন, অনেকের মধ্যে একটি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে যে, আমরা বুয়েট কর্তৃপক্ষ আইনি প্রক্রিয়ার বাহিরে থাকতে চাচ্ছি। এটি আসলে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আইনি প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক গতিতেই আমাদের অবশ্যই রেসপন্স করতে হবে এবং আমরা করব। ২০১৯ সালে আমরা যেই বিজ্ঞপ্তিটি দিয়েছিলাম সেটি কেন, কোন প্রেক্ষাপটে এবং আমাদের অর্ডিন্যান্সের কোন ক্ষমতাবলে ইত্যাদি উল্লেখ করে আমরা সেই জবাব দেব।

বুয়েট উপ-উপাচার্য বলেন, আইনি যে প্রক্রিয়া রয়েছে এটি শেষ অবধি আমরা কনটেস্ট করব। অ্যাপিলেট ডিভিশনে যাওয়া অ্যাপিল করা। মোট কথা আইনি প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ পথটিই আমরা ব্যবহার করব এবং সেখানে আমরা একা নই, আমাদের সঙ্গে আমাদের শিক্ষার্থী ও অ্যালামনাইরা থাকবেন।

আরও পড়ুন: নিয়মিত এক শিক্ষার্থী ছাড়া কেউই অংশ নেননি বুয়েটের পরীক্ষায়

বুয়েটে এখন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ কি না—এমন জিজ্ঞাসায় বুয়েটের উপ-উপাচার্য বলেন, যেহেতু আমরা কোর্টের কাছ থেকে আদেশ পাইনি। কোনো অর্ডার আমাদের হাতে আসেনি, কাজেই ২০১৯ সালের বিজ্ঞপ্তি ছিল সেটি এখন পর্যন্ত ভ্যালিড আছে বলেই আমরা মনে করি। আর যদি আইনি প্রক্রিয়ায় এমন হয়, বিশ্ববিদ্যালয় হেরে গেল, তাহলেই একমাত্র ক্যাম্পাসে রাজনীতি ফিরবে।

বিগত ২০১৯ সালের অক্টোবরে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এক ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’র মাধ্যমে ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। এরপর চলতি বছরের ২৭ মার্চ বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রবেশকে কেন্দ্র করে বিগত ২৯ মার্চ থেকে আন্দোলনে নামেন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

তারা গত ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা বর্জন ও অবস্থান কর্মসূচি করে শিক্ষার্থীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানের কথা জানান দেন। শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ইমতিয়াজ হোসেনকে বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার, ডিএসডব্লিউর পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করেন।

পরীক্ষা থাকলেও এদিন ক্যাম্পাসে ছিলেন না শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে বুয়েট ক্যাম্পাস থেকে তোলা। ছবি: টিডিসি ফটো।

শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ মার্চ রাতে ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ হোসেনের হলের আসন বাতিল করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। পরে সব রাজনৈতিক সংগঠন ও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার বিজ্ঞপ্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ইমতিয়াজের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১ এপ্রিল বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সেই ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’র কার্যক্রম স্থগিত করেন উচ্চ আদালত। ফলে ক্যাম্পাসে আবার ছাত্ররাজনীতি চালুর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। তবে নিজেদের শিক্ষালয়ে কোনো ধরনের ছাত্ররাজনীতি চান না বলে বরাবরই নিজেদের অনড় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন শিক্ষার্থীরা।

এছাড়াও গত ৩ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছিল, দুই দিনব্যাপী জনমত নিরীক্ষণের জন্য তাঁরা নিজ নিজ প্রাতিষ্ঠানিক ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে অনলাইনে ভোট গ্রহণ করেন। ৫ হাজার ৮৩৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে স্বাক্ষর করেছেন ৫ হাজার ৬৮৩ জন। অর্থাৎ ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে। পরদিন ৪ এপ্রিল থেকে ঈদ ও পয়লা বৈশাখ সামনে রেখে ১৩ দিনের ছুটি শুরু হয় বুয়েটে। ছুটি শেষে আবারও সব ধরনের কার্যক্রম শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সব ধরনের আয়োজন থাকলেও তাতে সাড়া নেই শিক্ষার্থীদের।