নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠুক বিশ্ববিদ্যালয়

ছবিতে বাংলা বিভাগের সভাপতি জাকিয়া সুলতানা মুক্তা
ছবিতে বাংলা বিভাগের সভাপতি জাকিয়া সুলতানা মুক্তা   © ফাইল ফটাে

২০০১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মভূমি গোপালগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জেরে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও দীর্ঘ ১০ বছর। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এরপরে প্রায় ১২ বছর পার হলেও এখনও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।

প্রতিনিয়তই বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-চিকিৎসা-আবাসন সহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১২ বছরে গড়ে ওঠেনি নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমনরুমও। তবে কেন্দ্রীয় কমনরুম নির্মাণ না হলেও সম্প্রতি বাংলা বিভাগ তাদের নারী শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে কমনরুম নির্মাণ করেছে। 

এ প্রসঙ্গে বিভাগটির সভাপতি জাকিয়া সুলতানা মুক্তা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন আজ পর্যন্ত নারী শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা কোনো প্রক্ষালন কক্ষ এর ব্যবস্থা করতে পারেনি। অথচ নারী শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিনিয়ত ঋতুস্রাবকালীন/গর্ভাবস্থায় আলাদা প্রক্ষালন ব্যবস্থা থাকাটা জরুরি। কেননা এ সময়ে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত না থাকলে, নারীদের নানান রোগ হতে পারে যা সন্তান জন্মদানের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। একারণে প্রতিষ্ঠিত সব বিশ্ববিদ্যালয়েই নারীদের জন্য আলাদা প্রক্ষালন ব্যবস্থার সুবিধা রয়েছে। যা এখানেও কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবিষ্যতে করবে বলে আমরা আশাবাদী। যদি কখনো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসহ নারী শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা প্রশাসন করতে পারে, তখন বাংলা বিভাগ আলাদা করে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে না। কিন্তু এর আগে পর্যন্ত বাংলা বিভাগে চালুরত নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা প্রক্ষালন ব্যবস্থা বজায় থাকবে এবং এতে আরও নিত্যনতুন সুবিধা বর্ধিতকরণের বিষয়টিও অব্যাহত থাকবে। যেমন- ভেন্ডিং মেশিনের ব্যবস্থাকরণ, ঋতুস্রাবকালীন ব্যবহারের জন্য আলাদা প্রক্ষালন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ (যেমন- আলাদা ওয়াশরুম, স্যানেটারি ন্যাপকিন ফেলার জন্য আলাদা ওয়েস্টবক্সের ব্যবস্থা), সাজ-সজ্জার জন্য আয়না ও ড্রেসিংটেবিলের ব্যবস্থা রাখা ইত্যাদি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে কমনরুমের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নারী শিক্ষার্থীদের জন্য এত বছরেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো কমনরুম, যা প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়েই বিদ্যমান। এই ধরনের সুবিধা এ জন্যই রাখতে হয় কেননা নারীরাই মানবজাতির আগামীর ভবিষ্যৎ তাদের গর্ভে ধারণ করেন। এজন্য তাদের প্রতি মাসে ঋতুস্রাবের সময় পার করতে হয়। আবার সন্তান জন্মদানের জন্য প্রায় এক বছর তাদের গর্ভবতীকালে নানান জটিলতা থাকে যখন তাদের জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন। এমনকি সন্তান জন্মদানের পরেও প্রায় বছর দু'য়েক বাচ্চাকে স্তনপান করাতে হয়। উক্ত সব ক্ষেত্রেই নারীদের আড়ালের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কারণ কারোর ঋতুস্রাবকালে প্রচণ্ড ব্যাথা থাকতে পারে (বিজ্ঞান দাবি করে এই ব্যাথা  কারোর কারোর ক্ষেত্রে আটটি(০৮) হার্ট এটাকের সমান হতে পারে যখন আলাদা কক্ষে কিছুক্ষণ বিশ্রামও তাদের জন্য অনেক বড় সমর্থন। এছাড়াও আপনারা খোঁজ নিলেই জানবেন যে সন্তান জন্মদানের সময়ে নারীদের প্রসববেদনা বিজ্ঞানের দাবি মোতাবেক বিশটি (২০) হার্ট এটাকের ব্যাথার চেয়েও বেশি হতে পারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে, সেখানে গর্ভকালে এর ছিটেফোঁটা ব্যাথা-বেদনা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এসময়ও নারীদের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। আর শিশুসন্তানকে সদ্য মা হওয়া নারীদের স্তনপান করানোর ক্ষেত্রে প্রতি দুই ঘন্টা পরপর আড়ালের আশ্রয় নিতে হয়। আমরা নিশ্চয়ই এটা এখনও দাবি করতে পারি না যে এদেশ এতটাই সংবেদনশীল হয়ে গেছে যে জন্মদাত্রী মা তার দুধের শিশুকে প্রকাশ্যে স্তনপান করাচ্ছে এমন দৃশ্য সমাজ সহজভাবে নিবে। সুতরাং এসবকিছু বিবেচনা করেই যেকোনো প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য কমনরুম থাকে এবং এটা বাঞ্চনীয় মোটেও বিলাসিতা নয়।’

কমনরুমে নামাজের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে এই শিক্ষক বলেন, ‘যারা পর্দানশীল নারী শিক্ষার্থী তাদের ক্লাস-পরীক্ষার ফাঁকে নিজেদের মতন আলাদা থাকার ব্যবস্থা এবং যারা নামাযী শিক্ষার্থী রয়েছেন তাদের জন্য নামাযের আলাদা ব্যবস্থা থাকাটাও জরুরি। আমি বলছি না মুসলিম প্রধান দেশ বলে কেবল মুসলিম নারী শিক্ষার্থীদের জন্য এমন ব্যবস্থা করতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয় যে ধর্ম পালনের জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আলাদা ব্যবস্থা করার দায় থাকে, এটা আমরাও বুঝি ও মানি। কিন্তু যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় পুরুষ শিক্ষক/শিক্ষার্থী/কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে, তবে নারীদের জন্য কেনো থাকবে না? যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে মসজিদের পাশাপাশি মন্দিরও রয়েছে, এর বিবেচনায় পূজা-অর্চনার ব্যবস্থাও বিভাগে রাখা যায় কিনা এমন দাবির প্রেক্ষিতে আমার বক্তব্য হলো ‘মেয়েদের কমনরুমে চাইলে নামায পড়া যায়, কিন্তু পূজা-অর্চনার সুযোগ তো সেভাবে করা যায় না। নামায পড়ার জন্য নিরিবিলি একটা আলাদা ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্ন স্থান হলেই চলে, কিন্তু সেটা পুরুষের সাথে একত্রে পড়ার সুযোগতো সেভাবে নেই। পূজার ক্ষেত্রে যত আয়োজন থাকে তা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভবও নয়, এমনকি পূজা-অর্চনার জন্য নারী/পুরুষের আলাদা স্থান নিয়েও কোনো বাড়াবাড়ি নেই। তাই আশা করি বাংলা বিভাগের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কমনরুমে নারী শিক্ষার্থীরা নামায পড়তে চাইলে তারা তা পড়তে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা বিচারে পূজা-অর্চনার বিষয়টি হয়তো সম্ভব হয়ে উঠবে না। এ নিয়ে যেনো ভবিষ্যতে কোনো দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি না হয়। যদি হয় তবে কমনরুমে প্রার্থনা করার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা হবে। কিন্তু আমি আশা করবো আপনারা সহিষ্ণুতা বজায় রেখে সংবেদনশীলতার সাথে বিষয়টিকে বিবেচনা করে চলবেন।

নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিভাগের উদ্যোগে কমনরুম নির্মাণের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যলয়ে কর্মরত নারী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো ডে-কেয়ার সেন্টার ছিলো না। অথচ এটি অত্যন্ত জরুরি, কেননা অনেকেরই পরিবার-পরিজন এখানে থাকেন না। তাদের শিশু সন্তানদের দেখভালের জন্য কোনো সমর্থন নেই। এমতবস্থায় একটি ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলে তারা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো আরও ভালোভাবে পালন করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। আমি এ বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছি, আমাকে আমার অপরাপর সহকর্মীরাও সমর্থন দিয়েছেন। ফলে ইতোমধ্যেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ডে-কেয়ার সেন্টারের অনুমোদন ও কক্ষ বরাদ্দ হয়েছে।  আমি এসকল বিষয় নিয়ে কাজ করেছি এ কারণেই যে সামগ্রিক স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে হলে এসব সুযোগ-সুবিধা থাকাটা বাঞ্চনীয় এবং একারণেই এসকল দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছি।’

এসিআই থেকে হলগুলোতে ফ্রী ভেন্ডিং মেশিন সরবরাহ করা হতে পারে জানিয়ে বাংলা বিভাগের সভাপতি আরও বলেন, ‘নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা প্রক্ষালন কক্ষ, কমনরুমের ব্যবস্থা, প্রার্থনা কক্ষের ব্যবস্থা, সমস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সিলের জন্য আলাদা সেলের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা অনেক শিক্ষকই কথা বলে যাচ্ছি। এগুলোকে শ্রেণিকক্ষ সংকট দেখিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বাংলা বিভাগের নারী শিক্ষার্থীদের প্রক্ষালন কক্ষে ভেন্ডিং মেশিনের ব্যবস্থা করার জন্য আমি এসিআই (ACI) কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করলে, তারা নারী শিক্ষার্থীদের জন্য হলগুলোতে বিনামূল্যে তা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। এ বছরের জুনেই মেয়েদের হলগুলোতে বিনামূল্যে ওনারা এর ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে বিভাগের জন্য ভাড়া দিবেন, এর জন্য বিভাগকে খরচ বহন করতে হবে। আমি বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করবো এ খরচ বহন করার জন্য। এসব কাজ এজন্যই করবো, কারণ আমি চাই এ বিশ্ববিদ্যালয় ধীরে ধীরে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও দৃষ্টান্তস্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম অর্জন করুক।’

প্রসঙ্গত, ০৮ জানুয়ারি প্রথম বিভাগ হিসেবে মেয়েদের কমনরুম উদ্বোধন করে বাংলা বিভাগ।


সর্বশেষ সংবাদ