আবরার হত্যার বিচারকাজ কতদূর?

আবরার ফাহাদ
আবরার ফাহাদ   © সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিনগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে নৃশংসভাবে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। পৈশাচিক এ হত্যাকাণ্ডের তিন বছরেও শেষ হয়নি বিচারকাজ।

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া মামলাটিতে ঢাকার বিচারিক আদালতে রায় হয় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর। এতে বিচারক ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তবে এতদিনেও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের শেষ আইনি ধাপ ডেথ রেফারেন্স শুনানিই শুরু করা যায়নি।

মামলা-সংশ্নিষ্টরা জানান, ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছেন আসামিরা। রাষ্ট্রপক্ষও বিধি অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) আবেদন করেছে। তবে শুনানি এখনও হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, মামলার পেপারবুক (এজাহার, রায়সহ যাবতীয় বৃত্তান্ত) তৈরি হলেই শুনানি শুরু করা যায়। তবে তা এখনও তৈরি হয়নি।

আবরার হত্যা মামলার বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর বলেন, হত্যা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য কিছু প্রক্রিয়া আছে। বিশেষ করে পেপারবুক তৈরি করতে হয়। আমরা (রাষ্ট্রপক্ষ) ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মামলার পেপারবুক তৈরির জন্য বলেছি। এটি তৈরি হলেই রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির উদ্যোগ নেবে।

বুধবার (৫ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আবরারের মা রোকেয়া খাতুনের সঙ্গে মোবাইল কথা হলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন,‘তিন বছর হয়ে গেছে আবরার খুন হয়েছে। এভাবে অনেক বছর হয়ে যাবে। এক সময় আবরারকে সবাই ভুলে যাবে। পরবর্তী প্রজন্ম যেন জানতে পারে, মনে প্রশ্ন জাগে কে এই আবরার। এজন্য তার নামে বুয়েট ক্যাম্পাসে যেন একটা স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘তিন বছর আগে এই সময় (৫ অক্টোবর সন্ধ্যায়) আবরার আমার কাছে ছিল। তাকে নাস্তা দিচ্ছিলাম। বলে আম্মু তুমি নাস্তা রেডি করো, আমি ৫ মিনিট পর আসতেছি। এরপর যদিও ফিরে এসেছিল। কিন্তু ঢাকা যাওয়ার পর তিন বছরেও আর ফিরলো না। আবরার আর বলবে না, আম্মু আসি।’

এদিকে আজ বড় ভাই আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন তার ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ। ফাইয়াজ বলেন, অক্টোবর আসলেই পেছনের সময়ের কথা মনে হয়। গত বছর এই অক্টোবরেই দাদিও মারা যান। প্রায় প্রতিটা কথাতেই আম্মু ভাইয়ার কথা মনে করেন। এখনো প্রায়ই কাঁদতে থাকেন। গত ৩ বছরে যত জনের সঙ্গে দেখা হয়েছে, প্রত্যেকের কাছেই ভাইয়ার জন্য দোয়া চেয়েছেন আম্মু। আব্বু-আম্মু দুইজনই বেশ অসুস্থ হয়ে গেছে। রাতে মাঝে মাঝেই আম্মু বলে ওঠে যে, ‘এই সময়ে আমার ছেলেকে কত মারছিলো, ও কতই চিৎকার করেছে। আশপাশের কুকুরগুলো পর্যন্ত ছোটাছুটি করছিলো তাও ওই পশুদের মনে দয়া হয়নি।

কিছুদিন পরেই হয়তো আমাদের ক্লাস শুরু হবে।সত্যি বলতে আমি নিজেও জানিনা তখন কী পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। যেই স্বপ্নের সৃষ্টি ভাইয়ার হাত ধরে, সেখানে ভাইয়াই নেই এখন। মাঝে মাঝে মনে হয় ভাইয়াকে যদি গত কয়েক বছর কী কী ঘটেছে জানাতে পারতাম, তাহলে ওর অনুভূতিটা কেমন হতো! আমাদের কাছে ভাইয়ার যে শূন্যতা সেটা যেন ক্রমেই বাড়ছেই।

তবে এত কিছুর মধ্যে ভালোলাগার জায়গা একটাই, ৩ বছর হয়ে গেলেও ভাইয়াকে অনেকেই এখনো ভুলেনি। হয়তো আরো বহুদিন মনে রাখবে আর দোয়া করবে।’

আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। সেখান থেকে ডেকে নিয়ে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। পরদিন নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ রাজধানীর চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। একই বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরের বছর ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করেন।

২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর আবরার হত্যা মামলায় ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— মেহেদী হাসান রাসেল (২৪), মো. অনিক সরকার অরফে অপু (২২), মেহেদী হাসান রবিন অরফে শান্ত (২৩), ইফতি মোশাররফ সকাল (২০), মো. মনিরুজ্জামান মনির (২১), মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (২৩), মো. মাজেদুর রহমান অরফে মাজেদ (২০), মো. মুজাহিদুর রহমান অরফে মুজাহিদ (২১), খন্দকার তাবাকারুল ইসলাম অরফে তানভির (২১), হোসেন মোহাম্মদ তোহা (২১), মো. শামীম বিল্লাহ (২১), মো. সাদাত অরফে এ এস এম নাজমুস সাদাত (২১), মুনতাসির আল জেমী (২০), মো. মিজানুর রহমান অরফে মিজান (২২), এস এম মাহমুদ সেতু (২৪), সামসুল আরেফিন রাফাত (২১), মো. মোর্শেদ অরফে মোর্শেদ অমত্য ইসলাম (২০), এহতেশামুল রাব্বি অরফে তানিম (২০), মোহাম্মদ মোর্শেদ উজ্জামান মণ্ডল প্রকাশ জিসান (২২) এবং মুজতবা রাফিদ (২১)। এর মধ্যে তানিম, প্রকাশ জিসান ও রাফিদ পলাতক রয়েছেন।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— অমিত সাহা (২১), ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (২১), মো. আকাশ হোসেন (২১), মুহতাসিম ফুয়াদ (২৩), ও মো. মোয়াজ অরফে মোয়াজ আবু হুরায়রা (২১)।

চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার যাবতীয় কাগজপত্র মূল নথিসহ ৬৬২৭ পৃষ্ঠার নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। এরপর গত ১২ জানুয়ারি দায়ের করা মামলার রায়ের কপি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।


সর্বশেষ সংবাদ