১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:২০

ফেলে দেয়া কাপড়ে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য

সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে পাবনার হোসিয়ারি শিল্পে  © টিডিসি ফটো

পাবনা পৌর সদরের সাধুপাড়া মহল্লার বাসিন্দা দেলোয়ারা খাতুন (৫০)। ১৮ বছর আগে স্বামী মারা যাবার পর আর্থিক টানাপোড়নে সংসার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরে বিয়ে দিয়েছেন এক ছেলেকেও, যার ঘরে রয়েছে দু’টি সন্তান। পাঁচ সদস্যের সংসারে অর্থের অভাব মিটছিল না কোনোভাবেই। ছেলের দিনমজুরের টাকায় সে অভাব মেটাতে হিমশিম খেতে হতো প্রতিনিয়ত। 

এ অবস্থায় তাদের পরিবারকে আশার আলো দেখায় ঝুট কারখানায় দেলোয়ারা খাতুনের একটি চাকরি। ছেলের দিন মজুরের আয়ের সাথে যুক্ত হয় মায়ের আয়। এই কারখানায় কাজ করে তিনি মাসে আয় করেন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। মা আর ছেলের উপার্জনে বেশ সচ্ছল হয়ে উঠেছে তাদের জীবনে।

শুধু দেলোয়ারা খাতুনের জীবনেই না, এমন গল্প ছড়িয়ে আছে আরো হাজারো ঝুট কারখানা শ্রমিকদের জীবনে। দারিদ্র্য কমাতে আলো সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে কারখানাগুলো। কর্মক্ষম মানুষের পাশাপাশি বৃদ্ধদেরও কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে কারখানাগুলো, কারোর মুখাপেক্ষী না হয়ে চালাতে পারছেন নিজের খরচ।

আরও পড়ুন: সাভার-আশুলিয়া-গাজীপুরের প্রায় সব কারখানাই খোলা

ঝুট কাপড় অর্থাৎ গার্মেন্টেসের উচ্ছিষ্ট কাপড় দিয়ে এমনই এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে পাবনার হোসিয়ারি শিল্পে। ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে গেঞ্জিসহ নানা বস্ত্র। যা সুনাম কুড়িয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। পাবনা হোসিয়ারি ম্যানুফ্যাকচারার্স গ্রুপের তথ্য মতে, বর্তমানে ঝুট কাপড় থেকে উৎপাদিত বস্ত্র থেকে বছরে আয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। আর এ শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার নারী-পুরুষের।

হোসিয়ারি ব্যবাসায়ীরা জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের তৈরি পোশাক কারখানায় প্রতিদিন ফেলে দেওয়া হয় নমুনা ও কাটিংয়ের কাপড়। যা ঝুট কাপড় হিসেবে পরিচিত। সেই ঝুট কাপড় কিনে এনে উন্নতমানের গেঞ্জিসহ নানা বস্ত্র তৈরি করছেন পাবনা হোসিয়ারী ব্যবসায়ীরা।

সাধুপাড়া মহল্লার মামুন হোসিয়ারির মালিক মামুন হোসেন জানান, ‘প্রথমে ঝুট কাপড় কিনে আনার পর প্রসেসিং ও কাটিং করা হয়। তারপর সেলাই মেশিনে তৈরি হয় গেঞ্জি সহ নানা পরিধেয় বস্ত্র। এরপর বিভিন্ন ডিজাইনের ছাপ দেয়া শেষে করা হয় প্যাকেজিং। এমনই কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে উৎপাদিত বস্ত্র চলে যাচ্ছে সারাদেশে। সুনাম কুড়িয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও।’

ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য মতে, গত এক দশকে পাবনা সদর উপজেলার আশপাশে বিভিন্ন গ্রামে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা গড়ে তুলেছেন ঝুট কাপড় থেকে গেঞ্জি তৈরির ৫৪২টি হোসিয়ারি কারখানা। প্রতিবছর এসব কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ কোটি পিস গেঞ্জি। যার বাজারমূল্য ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা।

আরও পড়ুন: সংকটে পোশাক শিল্প, ক্রয়াদেশ যাচ্ছে ভারত পাকিস্তান শ্রীলঙ্কায়

এস এ হোসিয়ারীর স্বত্বাধিকারী আলাল উদ্দিন প্রামানিক বলেন, ‘আমি প্রায় ১৫ বছর ধরে এই ব্যবসা করছি। আমার কারখানায় ৭০ থেকে ৭৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। খরচ বাদে মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ থাকে। বলা যায় ঝুট কাপড়ই আমাদের হোসিয়ারি শিল্পের প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে। অনেক ব্যবসায়ীর ভাগ্য ফিরেছে এই ব্যবসায়।’

রাসেল গার্মেন্টস এর মালিক আলহাজ আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আগে গার্মেন্টস চাকুরি করতাম। ১০ বছর আগে সেই চাকুরি ছেড়ে ২/৩ টা সেলাই মেশিন নিয়ে এসে নিজের এলাকায় এসে কাজ শুরু করি। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন আমার কারখানায় একশ’ মেশিন চলে, দুইশ’ শ্রমিক কাজ করেন। এখানকার তৈরি পোশাক দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভারত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছি। সরকার থেকে সুদ মুক্ত ঋণ পেলে এ খাতে আমরা আরো মানুষের কর্মসংস্থান করে দিতে পারবো।’

রুমী খাতুন, সাথী খাতুন নামের দুই শ্রমিক বলেন, ‘অনেক বেকার যুবক ও গ্রামের দরিদ্র অসহায় নারীরা কারখানায় কাজ করে মাসে অন্তত ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন। এতে অনেকের সংসারের অভাব চলে গেছে। স্বামী সন্তান  নিয়ে সুখে আছে। ঝুট কারখানাগুলো আমাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।’

ষাটোর্ধ্ব চাঁদ আলী ও মন্টু প্রামানিক নামের দুই প্রবীণ শ্রমিক বলেন, ‘আমরা এই বয়সে সংসারের বোঝা হয়ে যাই। ছেলে সন্তান অনেকেই ভরণ পোষণ দিতে চায় না। কিন্তু এই জুট কারখানা আমাদের কষ্ট দূর করেছে। আমরা এখন নিজেদের খরচ নিজেরাই চালাই। কারো দিতে তাকিয়ে থাকতে হয় না।’

পাবনা হোসিয়ারি ম্যানুফ্যাকচারার্স গ্রুপের সভাপতি মনির হোসেন পপি বলেন, এই জেলা র হোসিয়ারি শিল্পের সুনাম দেশজুড়ে। বিদেশেও অনেক সুনাম হয়েছে। যার কারণে ভারত, মালয়েশিয়ায় আমাদের গেঞ্জিসহ অন্যান্য বস্ত্র রপ্তানি হচ্ছে। আমরা আরো অনেক দেশে রপ্তানি করতে চাই। এজন্য দরকার আর্থিক সহযোগিতা। কারণ আমাদের পুঁজি অল্প। সুদমুক্ত ঋণ পেলে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনবেন পাবনার ব্যবসায়ীরা।’

পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল আলম স্বপন চৌধুরী বলেন, ‘বিগত করোনা মহামারি ও ইউক্রেন সহ বহির্বিশ্বের যুদ্ধ পরিস্থিতি পাবনার হোসিয়ারি শিল্পকে ধাক্কা দিয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী কারখানা বন্ধ করে দিয়েছিল। ধীরে ধীরে আবার প্রাণ ফিরেছে। এ শিল্পের প্রসারে ও বস্ত্র রপ্তানিতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি।’