বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে, কমছে রিজার্ভ
বাংলাদেশের দিন দিন বিদেশি ঋণের বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে অনুপাতে ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে সে অনুযায়ী পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। ফলে দেশের ঋণের চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ যদি এখন নতুন করে আর কোনো বিদেশি ঋণ না নিলেও এপর্যন্ত করা ঋণ শোধ করতে ২০৬২ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে । আর গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ছয় বছর পর ২০২৯-৩০ অর্থ বছরে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলার। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশকে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিলো। ১০ বছরে ২০২১-২২ অর্থ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০১ কোটি ডলার।
গত ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোন করেছে। যার প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করেছে। এছাড়া বিশ্ব ব্যাংকের কাছে ঋণ এক হাজার ৮১৬ কোটি ডলার, এডিবির কাছে এক হাজার ৩২৮ কেটি ডলার, জাপান ৯২৩ কোটি ডলার, রাশিয়া ৫০৯ কেটি ডলার এবং চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৭৬ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই মাসে তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৬.১৪ লাখ কোটি টাকা। দেশে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার ১৯ টাকা। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ মোট জিডিপির ১৭ শতাংশ। আর সরকারের মোট ঋণের মধ্যে বৈদেশি ঋণ ৪৩.৫ শতাংশ।
অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে ২৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী এই অর্থ আগের বছর একই সময়ের চেয়ে ৪১ শতাংশ বেশি।
চলতি অর্থ বছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। আগের অর্থ বছরে শোধ করতে হয়েছে ২৭৪ কোটি ডলার। আর এখ পর্যন্ত বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮২.৮৫ বিলিয়ন ডলার।
দেশে ঋণ-জিডিপির অনুপাত ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২০১৪ সালে ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮.৭ শতাংশ, যা এখন ৪২. ১ শতাংশ।
আরও পড়ুন: গ্রাহকের আস্থা হারিয়ে ফেলছে দেশের ব্যাংক খাত
ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে ইআরডি বলছে, বৈদেশিক সহায়তায় বাস্তবায়ন করা বড় বড় প্রকল্পগুলোর জন্য অর্থ ছাড় বৃদ্ধি পেয়েছে। মেট্রো রেল, মাতারবাড়ি, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বৃহৎ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে থাকায় সম্প্রতি এগুলো জন্য অর্থ ছাড় বেড়েছে।
এদিকে ঋণের অর্থনেতিক সহায়তা ছাড় কমছে। জুলাই মাসে অর্থ ছাড় ৪০ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের মতো, গত অর্থবছরের জুলাইয়ে যা ছিল ৪৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অবশ্য ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে। জুলাই মাসে ৫০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, যা গত অর্থবছরের একই মাসে ছিল ১১ লাখ ডলারের কম। বাংলাদেশের জন্য পাইপ লাইনে ৪০ হাজার কোটি ডলার আছে।
অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম জানান,‘‘আমরা বিদেশি ঋণ নিয়ে অনেক স্বল্প প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করেছি। এটা আমাদের একটা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, পদ্মা সেতু দিয়ে রেলপথ, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ, দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প- এগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। এগুলোর ঋণের কিস্তি দেয়া শুরু হয়েছে বলে এখন আমরা বিপদে পড়েছি।”
তিনি জানান,‘‘যখন এপর্যন্ত নেয়া সব ঋণের সুদ ও আসলে কিস্তি দেয়া শুরু হবে তখন প্রতিবছর আমাদের চার বিলিয়ন ডলারের বেশি শোধ করতে হবে। ২০২৭-এর দিকে এটা পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।”
তার কথা, ‘‘এই পরিস্থিতি আমাদের রিজার্ভের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে। এখন আমাদের রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। রিজার্ভের এই পতনের ধারা থামবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ করতে পারব৷”
এদিকে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে গতি বাড়েনি। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৭৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। সে হিসেবে দিনে এসেছে চার কোটি ৯৩ লাখ ৩২ হাজার ডলার। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪৮ কোটি ডলার। এরকম চলতে থাকলে আগের মাসের চেয়ে প্রায় ১১ কোটি ডলার কম হবে। আগস্ট মাসে কমে রেমিট্যান্স ২১ শতাংশ।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে