ব্যাংকের উদাসীনতায় ব্যয় হয় না সিএসআরের অর্থ, বঞ্চিত শিক্ষা খাত
দেশের ব্যাংকগুলোর কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) পর্যাপ্ত বাজেট থাকলেও শিক্ষা খাতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে অর্থ ব্যয় হচ্ছে না। এ বছরের জুন পর্যন্ত শিক্ষাখাতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা, যা জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৪ এর তুলনায় ২২.৯৮ শতাংশ কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ অর্থ খরচ না হওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোর উদাসীনতাকে দায়ী করে তদারকি বাড়াতে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর সিএসআর অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ৩০ শতাংশ করে মোট ৬০ শতাংশ; পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ২০ শতাংশ এবং আয়-উৎসারী কাজ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্রীড়া, সংস্কৃতিসহ অন্যান্য খাতে বাকি ২০ শতাংশ খরচ করা যাবে। তবে কোনো ব্যাংক নিট লোকসানে থাকলে সিএসআর খাতে কোনো ব্যয় করতে পারবে না।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সিএসআর খাতের ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিক্ষাখাতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। যদিও ২০২৪ বছরের একই সময়ে এই খাতে ব্যয় হয়েছিল ৬৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আর ২০২৪ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে শিক্ষাখাতে ব্যাংকগুলো ব্যয় করেছিল ৪৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। যদি আগের সময়ের তুলনায় এবার সিএসআর ব্যয়ের হারে কিছুটা এগিয়েছে শিক্ষাখাত। সিএসআরে মোট খরচের ২২.৭৫ শতাংশ খরচ হয়েছে এই খাতে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ৩০ শতাংশ পূরণ করতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
রাষ্ট্রয়াত্ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের সিএসআর বাজেট রয়েছে ২৬.৭০ কোটি টাকা, কিন্তু প্রথম ছয়মাসে খরচ করেছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। রূপালী ব্যাংকের বাজেট চার কোটি, তারা খরচ করেছে মাত্র ২০ হাজার টাকা। একই চিত্র বেসরকারি ব্যাংকগুলোরও, পর্যাপ্ত বাজেট থাকলেও শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সেসব অর্থ খরচ হয়নি।
এ বছর সিএসআরে সর্বোচ্চ ২৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে শাহজালাল ইসলামী ১৪ কোটি, যমুনা ব্যাংক ১২ কোটি, প্রিমিয়ার ১১ কোটি, পূবালী ৯ কোটি ৮০ লাখ, এক্সিম ৭ কোটি, ইসলামী ব্যাংক ৬ কোটি ৬৮ লাখ, ডাচ্-বাংলা ৬ কোটি ৬৫ লাখ, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ৬ কোটি ৩০ লাখ এবং ঢাকা ব্যাংক ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে শিক্ষাখাতে ব্যয় করেছে যথাক্রমে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৬০ হাজার, শাহজালাল ইসলামী সাড়ে ৩ কোটি, যমুনা ব্যাংক এক কোটি ৮৩ লাখ, প্রিমিয়ার ৪০ হাজার, পূবালী ৫ কোটি ৬৭ লাখ, এক্সিম ৬ কোটি, ইসলামী ব্যাংক ২০ লাখ, ডাচ্-বাংলা ৩ কোটি ৩০ লাখ, আল-আরাফাহ্ ইসলামী এক কোটি ২৫ লাখ এবং ঢাকা ব্যাংক ২০ লাখ টাকা।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক সবচেয়ে বেশি টাকা শিক্ষাখাতে ব্যয় করেছে, তাদের খরচকৃত অর্থের পরিমাণ ৬ কোটির কিছু বেশি। তালিকায় এর পরেই রয়েছে পূবালী ব্যাংক (৫.৬৭ কোটি), শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক (৩.৫৪), ডাচ বাংলা (৩.০৩ কোটি), ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (২.৮১ কোটি)। দেশের মাত্র নয়টি ব্যাংক প্রত্যেকে এক কোটি টাকার বেশি খচর করেছে।
সিএসআর বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাষ্ট্রয়াত্ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের সিএসআর বাজেট রয়েছে ২৬.৭০ কোটি টাকা, কিন্তু প্রথম ছয়মাসে খরচ করেছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। রূপালী ব্যাংকের বাজেট চার কোটি, তারা খরচ করেছে মাত্র ২০ হাজার টাকা। একই চিত্র বেসরকারি ব্যাংকগুলোরও, পর্যাপ্ত বাজেট থাকলেও শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সেসব অর্থ খরচ হয়নি।
বিষয়টি শিক্ষার প্রতি উদাসীনতার উদাহরণ বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষার প্রতি উদাসীন, জাতিগতভাবে শিক্ষার প্রতি অবহেলা করি, এই চিত্র তারই প্রতিফলন। আমরা যদি খুব গভীরে আমরা যাই, দেখবো যে ওই টাকাগুলো নিয়মের মধ্যে অনিয়ম করা হয়। যেমন তাদের পরিচিত কাউকে দিলো চিকিৎসার নামে, বা এই নামে সেই নামে বিদেশে ভ্রমণ করল। অর্থাৎ টাকাটা যে খাতে খরচ করার কথা, সে খাতে খরচ হচ্ছে না।’
আরও পড়ুন: শিক্ষার্থী সংখ্যায় এগিয়ে দেশের যে ২০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাখাতে নির্দেশনা অনুযায়ী খরচের জন্য সংশ্লিষ্টদের জোরালো মনিটরিং প্রয়োজন বলেও মনে করেন ঢাবির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও তা পূরণ না করতে পারা অনিয়ম। নির্দেশনা আপনাকে মানতেই হবে, যেহেতু নিয়ম আছে, সেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের কিংবা সংশ্লিষ্টদের জোরালো মনিটরিং লাগবে এবং তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা খাতে ব্যয় বললেই হবে না, তা ঠিক শিক্ষার কোন ক্ষেত্রে খচর হচ্ছে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এটা যেন এমন না হয় যে, কোন একজন এমডি কিংবা কোনো একজন পরিচালকের আত্মীয়কে সুবিধা দেয়া হচ্ছে। একেবারে নির্দিষ্ট যে জায়গাটায় প্রয়োজন, সমাজ-রাষ্ট্রের শিক্ষার ওই জায়গাটায় ব্যয় নিশ্চিত করা জরুরি।’
ব্যাংকসূত্র বলছে, নিট মুনাফা কমায় ব্যাংকগুলোর করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাতে ব্যয় কমে অর্ধেকে নেমেছে। চলতি ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাস জানুয়ারি-জুনে ব্যাংকগুলোর সিএসআরে ব্যয় হয়েছে ১৫১ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩০৯ কোটি টাকা। এর আগে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে এই খাতে ব্যাংকগুলো ব্যয় করেছিল ৫৭১ কোটি টাকা। সিএসআর ব্যয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব ব্যাংক আগে সিএসআর ব্যয়ে এগিয়ে ছিল, তার অনেকগুলোই ইতিমধ্যে লোকসানে পড়েছে। আবার কোনো কোনোটি মুনাফা কমায় সিএসআর ব্যয় কমিয়েছে। ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ও কর পরিশোধের পর নিট লোকসানে পড়েছে ১৫টির বেশি ব্যাংক। এ তালিকায় রয়েছে সরকারি মালিকানার জনতা, অগ্রণী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি (বিকেবি) ও রাজশাহী উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। আরও আছে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, পদ্মা, আইএফআইসি, এবি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকসহ কয়েকটি।