খেলনা শিল্পে রপ্তানি বাড়াতে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব ও শুল্ক সংস্কারের দাবি
বাংলাদেশের খেলনা শিল্প ধীরে ধীরে রপ্তানিমুখী খাতে পরিণত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়লেও এই খাতের টেকসই উন্নয়নের পথে এখনও রয়েছে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে কাঁচামাল ও প্যাকেজিং উপকরণ আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, আন্তর্জাতিক মান পরীক্ষার জন্য দেশে স্বীকৃত কোনো পরীক্ষাগার না থাকা, এবং বিদেশি লাইসেন্সপ্রাপ্ত খেলনার বাজারে প্রবেশে জটিলতা অন্যতম।
মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভায় এসব বিষয় উঠে আসে। ‘রপ্তানি বহুমুখীকরণ: খেলনা উৎপাদন শিল্পে উদ্ভাবন এবং রপ্তানির সম্ভাবনা’ শীর্ষক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের বিষয়টি বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিগত বছরগুলোতে আমাদের রপ্তানি গুটিকয়েক পণ্যের উপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল। ডিসিসিআই সভাপতি জানান, খেলানা সামগ্রী রপ্তানির বৈশ্বিক বাজার ১০২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যেটি ২০২৩০ সালে ১৫০ বিলিয়নে পৌঁছাবে, সেখানে এখাতে আমাদের রপ্তানি মাত্র ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের অনুপস্থিতি, টেস্টিং সুবিধার অপ্রতুলতা, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকারের সীমাবদ্ধতা, ব্যবহৃত কার্চামালে আমদানি নির্ভরতা ও আমদানি পণ্যের উপর উ”চ শুল্কারোপ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এবং সহায়ক নীতিমালার অভাবে এখাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মত পোষন করেন তাসকীন আহমেদ।
আরও পড়ুন: ১৯তম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি শিগগিরই, কঠিন হতে পারে প্রশ্ন
এনবিআারের সদস্য মুহাম্মদ মুবিনুল কবীর বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে তৈরি পোষাকের পাশাপাশি সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতের উপর নজর দিতে হবে, এলক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংশ্লিষ্ট নীতিমালা সহজীকরণ ও বন্ডেড সুবিধা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে প্রণীত ট্যারিফ নীতিমালার অনুসারে রাজস্ব বিভাগ শুল্ক আরোপ করে থাকে এবং এক্ষেত্রে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর কিছু সুপারিশ থাকে, যা মেনে চলতে হয়। অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে কোন নীতি সহায়তা পরিবর্তনের তেমন সুযোগ নেই, তবে আগামী বছরে বাজেট প্রণয়নে এখাতের প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদানের বিষয়টি সরকারের বিবেচনার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। এনবিআর সদস্য আরো বলেন, গত ৪০ বছর ধরে তৈরি পোষাকখাতে সহায়তা দেওয়া হলেও এখাতের সক্ষমতা কতটুকু বেড়েছে তা নিয়ে চিন্তার সময় এসেছে, তাই খেলনা শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রাপ্তির চাইতে নিজেদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো এবং পণ্যের উদ্ভাবনী কার্যক্রমে বেশি হারে মনোযোগী হওয়ার উপর তিনি জোরারোপ করেন।
বৃটিশ হাইকমিশনের ডেপুটি ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর মার্টিন ডওসন বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত খেলনা পণ্য রপ্তানির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এবং বৃটিশ সরকার এখাতে সহযোগিতা করতে বেশ আগ্রহী। বিদ্যমান নীতিমালার সংষ্কার ও প্রতিবন্ধকতা নিরসন করা সম্ভব হলে বৃটেনে এখাতের পণ্যের রপ্তানি আরো বহুগুন বাড়বে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, বৃটিশ সরকার সম্প্রতি রুলস অব অরিজিনের শর্তাবলী সহজীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের তার দেশে পণ্য রপ্তানি সম্প্রসারণে সহযোগিতা করবে। তিনি উল্লেখ করেন, এনবিআর শিল্পখাতের কাঁচামালের কাস্টম্স ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া সহজীকরণ সহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা নিরসন করেছে, যা বাংলাদেশের সামিগ্রক রপ্তানি সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং জালালাবাদ পলিমারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, প্লাস্টিক খাতে বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজারের মত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ২৫০টি খেলনা সামগ্রী উৎপাদনের সাথে জড়িত এবং এখাতে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ কর্মরত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং দেশের আভ্যন্তরীণ বাজারের পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
তিনি জানান, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খেলান সামগ্রী রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৫.২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৮টি দেশে রপ্তানির মাধ্যমে তা ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে পণ্যের মান নিশ্চিতকরণ, অপ্রতুল অবকাঠমো, গবেষণা কার্যক্রমের অনুপ¯ি’তি এবং নতুন পণ্যের ডিজাইন উদ্ভাবনে পিছিয়ে থাকা প্রভৃতি বিষয়সমূহের কারণে এখাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে শামীম আহমেদ অভিমত প্রকাশ করেন। সেই সাথে এখাতের সার্বিক উন্নয়নে ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট, পণ্য উদ্ভাবন কাজে মানব সম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান, জয়েন্ট ভেঞ্চার বিনিয়োগকে উৎসাহিত করণ, অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন, প্লাস্টিক খাতের উন্নয়ন নীতিমালার মধ্যেই খেলনা সামগ্রী শিল্পের নীতিমালা প্রণয়ন, পণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির উপর সম্পূরক শুল্ক হ্রাস প্রভৃতির উপর তিনি জোরারোপ করেন।
আরও পড়ুন: আগের ফাইল বাদ, তিন দপ্তরের বাড়ি ভাড়ার প্রস্তাব একসঙ্গে পাঠাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
এছাড়াও অনুষ্ঠানটির নির্ধারিত আলোচনায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের পরিচালক ড. অশোক কুমার রয়, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের জয়েন্ট চীফ (ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেট ডিভিশন) মোঃ মামুন-উর রশিদ আসকারী, গোল্ডেন সন লিঃ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল আহেমদ, কাপকেক এক্সপোটার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াসির ওবায়েদ, প্রেমিয়াফ্লেক্স প্লাস্টিকস লিমিটেডের ডেপুটি এক্সিকিউটি ডিরেক্টর মোঃ আনিসুর রহমান, পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (বর্জ্য এবং কেমিক্যাল ব্যবস্থাপনা) ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন, আমান প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি’র প্রোপাইটর আমান উল্ল্যাহ, হ্যাসি টাইগার কোম্পানী লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মুসা বিন তারেক এবং রেডমিন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মোঃ জহিরুল হক অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনায় বক্তারা জানান, খেলনা শিল্পের কাঁচামাল এবং প্রয়োজনীয় প্যাকেজিং উপকরণ আমদানিতে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করায় দেশীয় উৎপাদকদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের। অন্যদিকে দেশে খেলনার গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো পরীক্ষাগার নেই। ফলে, রপ্তানির আগে বিদেশে পরীক্ষা করাতে গিয়ে বাড়তি সময় ও খরচ গুণতে হয়। এতে দেশের খেলনা শিল্প বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। এক দশক আগেও বাংলাদেশের বাজারে থাকা ৮০ শতাংশ খেলনা আমদানিকৃত ছিল। কিন্তু এখন এই চিত্র পাল্টে গেছে। বর্তমানে দেশে প্রয়োজনীয় খেলনার প্রায় ৮০ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন শুধু বাজার দখল নয়, বরং দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি বড় প্রমাণ।
বক্তারা মনে করেন, খেলনা শিল্পকে টেকসই ও রপ্তানিমুখী খাতে রূপান্তর করতে হলে এখনই নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। এর মধ্যে শুল্কহার যৌক্তিক করা, মান পরীক্ষার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাব স্থাপন, প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। সরকারের সহযোগিতা ও বেসরকারি বিনিয়োগ একসঙ্গে হলে খেলনা শিল্প দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হতে পারবে। এতে যেমন বৈদেশিক আয় বাড়বে, তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগও বাড়বে বহুগুণ।