ভুয়া বিল-ভাউচারে ১৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রতিষ্ঠানপ্রধানের বিরুদ্ধে
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার আউলিয়াবাদ রামকেশব উচ্চ বিদ্যালয়ে গত ১২ বছরের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নানা অসঙ্গতি ও নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার প্রাথমিক তদন্তের পর বিদ্যালয়ের আর্থিক নথিপত্র পর্যালোচনায় অসংখ্য অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে। এ সময়ে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ১৩ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানপ্রধান সৈয়দ আছাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি আউলিয়াবাদ রামকেশব উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানপ্রধান সৈয়দ আছাদুজ্জামানের নানা অনিয়ম নিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের পর প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি দল আট বছরের অডিট সম্পন্ন করে। এ অডিট রিপোর্ট বর্তমানে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে রয়েছে। তবে অভিযোগ উঠেছে, প্রধান শিক্ষক মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিষয়টি সমঝোতা করার চেষ্টা করছেন।
অডিট রিপোর্ট এবং বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রধান শিক্ষক সৈয়দ আছাদুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরে কোনো উপকমিটি ছাড়াই এককভাবে আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নীতিমালা-২০২৩ অনুযায়ী প্রতি বছর অডিট কমিটি গঠন ও ৩১ জানুয়ারির মধ্যে পূর্ব বছরের অডিট নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা থাকলেও গত ১২ বছরে কখনো কোনো অডিট কমিটি গঠন করা হয়নি।
২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ের মোট আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকার বেশি। আর মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ২৯ হাজার টাকার মতো। কিন্তু এসব হিসাবের সঙ্গে উত্থাপিত ভাউচার ও ব্যাংক নথির সামঞ্জস্য নেই বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে যেসব ভাউচার ও আর্থিক নথি সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেগুলো যথাযথ স্বাক্ষরবিহীন, অসম্পূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে নেওয়া ১৩ লাখ টাকার মধ্যে ইতোমধ্যে তিন লাখ টাকা ফেরতও দিয়েছেন তিনি।
যদিও এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন আউলিয়াবাদ রামকেশব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ আছাদুজ্জামান। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘স্কুলের শিক্ষকদের একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। তারা ডিসি বরাবর অভিযোগ দিয়ে আমার বিরুদ্ধে অডিট করিয়েছেন। আমি টাকা আত্মসাৎ করিনি।’ অডিট হওয়ার পর ৩ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। ব্ল্যাকমেইলের কারণে আমি ৩ লাখ টাকা দিয়েছি।’
অনুসন্ধানে গেছে, ডিসির কাছে অভিযোগ দেওয়ার পর গত ২৩ জুন শিক্ষা কর্মকর্তা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে প্রধান শিক্ষককে সাত কর্মদিবসের মধ্যে অডিট কমিটি গঠন করে ১২ বছরের অভ্যন্তরীণ অডিট সম্পন্ন করার মৌখিক নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষক এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে আট বছরের অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করে।
অডিট প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ের মোট আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকার বেশি। আর মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ২৯ হাজার টাকার মতো। কিন্তু এসব হিসাবের সঙ্গে উত্থাপিত ভাউচার ও ব্যাংক নথির সামঞ্জস্য নেই বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক ভাউচারে অফিস সহকারী, নিরীক্ষক, খরচকারী বা সভাপতির স্বাক্ষর নেই। একই খরচের বিপরীতে একাধিক ভাউচার পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত ফরম ফিলআপ ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি, প্রশংসাপত্র ফি, দাতা সদস্য ফি ইত্যাদি খাত যথাযথভাবে ব্যাংকে জমা হয়নি। রশিদবই, দৈনিক আদায় হিসাব, পেটি ক্যাশ এবং মূল ক্যাশবুকের মধ্যে হিসাব স্থানান্তরের নিয়ম মানা হয়নি।
অডিট প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আদায়কৃত অনেক অর্থ ব্যাংক থেকে উত্তোলন করার পরিবর্তে নগদ হাতে খরচ করা হয়েছে। আপ্যায়ন, যাতায়াত, ফটোকপি, প্রশ্নপত্র তৈরি, আইটি ল্যাব এবং মনিহারি সামগ্রীর খাতে অস্বাভাবিক ব্যয় পাওয়া গেছে। ২০২০ সালের নবম ভোক ও ২০২১ সালের দশম ভোক আদায় হিসাবের নথিও উপস্থাপন করা হয়নি।
বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যালয়ের যে বিপুল অঙ্কের অর্থ শিক্ষার্থী ও সরকারি-বেসরকারি উৎস থেকে আসে, তা কীভাবে খরচ হয়েছে- তার নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। এটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে।
আরও পড়ুন: ৪৫তম বিসিএস: ৫০২ পদে সুপারিশযোগ্য প্রার্থী পায়নি পিএসসি
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে স্কুলের এক সহকারী শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী ক্রয় উপকমিটি কিংবা বেতন ও ফি আদায় উপকমিটি গঠন না করায় বিদ্যালয়ের আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি অস্বচ্ছ। এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি যে কোনো সময় প্রশাসনিক জটিলতায় পড়তে পারে। আর্থিক অনিয়ম অব্যাহত থাকলে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নমূলক কাজ, অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, আইটি ও ল্যাব সুবিধা, শিক্ষকের প্রশিক্ষণসহ স্কুলের নানা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি সমাধান হওয়া উচিত।’
আরেক শিক্ষক বলেন, ‘তারা প্রধান শিক্ষকের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। প্রতিষ্ঠান প্রধানের কেনাকাটাসহ অনিয়মগুলো দ্রুত তদন্ত করা দরকার। এটি না হলে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটতে পারে। প্রতিষ্ঠানপ্রধান যে টাকাগুলো নিয়েছেন সেগুলো ফেরত নেওয়াসহ অনিয়মের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মো. সিরাজুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে যোগসাজসের বিষয়টি সঠিক নয়। কারা অভিযোগ করেছে সেটি আমার জানা নেই। অডিট রিপোর্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।