হত্যার এক দশক: বেঁচে থাকলে হয়তো আজ ঢাবির শিক্ষক হতেন
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:২৭ AM , আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:০৬ AM
আবু বকর ছিদ্দিক। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে ভর্তি হয়েছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। কিন্তু সন্ত্রাসের জাঁতাকল তাকে এগুতে দেয়নি। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের শিকার হয়ে ২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রাণ হারাতে হয় তাকে। সে হিসেবে আজ আবু বকরের দশম মৃত্যুবার্ষিকী।
আবু বকর স্মরণে তার বন্ধু রণি লিখেছেন, বন্ধু বা পরিচিতজন হিসেবে বলছি না, যারাই তাকে চিনতো সবাই আমার সাথে একমত হবেন যে, সে সবসময় হাসিখুশী মাখা সুন্দর মনের অধিকারী ছিল। তার পারিবারিক অবস্থা যে এতটা খারাপ সেটা কখনোই তার মুখ দেখে বা ব্যাবহারে প্রকাশ পেত না।
তাকে হত্যার দিন সে তার রুমেই ছিল। নোংরা রাজনীতির প্রথা অনুযায়ী কোন এক রাতে হলের সিট দখলকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। দূর্ভাগ্যবশত আমিও একটি গ্রুপের অংশ ছিলাম। সংঘর্ষটি যদিও সূচনা হয়েছিল হলের সিটকে কেন্দ্র করে কিন্তু মূল ছিল ইউনিভার্সিটির নতুন দুইটি হলের শত কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। যা হোক দুই গ্রুপের সংঘর্ষের একটি পর্যায়ে পুলিশ হলে প্রবেশ করে এবং একচেটিয়া লাঠি চার্জ শুরু করে। সাধারণ ছাত্ররাই এতে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাজনৈতিক নয় বরং অনেক সাধারণ রুমে প্রবেশ করে পুলিশ বেপড়োয়া ভাবে লাঠি চার্জ করেছিল এবং সর্বশেষ বন্ধু বকরের মাথায় গুলি করে পুলিশ। (২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে তার মাথায় গুলি করা হয়, আহত অবস্থায় একদিন পর মারা যায়।)
রুমের প্রত্যক্ষদর্শী সকল বড় ভাই এবং অন্য বন্ধু বলেছিল যে, পুলিশ ৫ তলার ৫০৩ নাম্বার রুমে ঢুকে ৪ তলার ৪০৫ নাম্বার রুমের বেলকনির দিকে গুলি ছোড়ে। যার একটি আঘাত করে বেলকনিতে অবস্থানরত বন্ধু বকর কে। এমনকি পুলিশের চার্জ সহ্য করতে না পেরে ৫০৩ নাম্বার রূম থেকে লাফ দিয়ে সেদিন দুইজন সাধারণ ছাত্র পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ঘটনার সময় আমি নিজে ৫০৪ নাম্বার রুমে বন্ধু বাধনের সাথে অবস্থান করছিলাম। ৫০৩ নাম্বারে পুলিশের ভয়ংকর ভূমিকায় আমরা যারা পাশের রুমে ছিলাম তারা চরম মাত্রায় ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম পুলিশ আমাদের রুমেও আসবে।
পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ডটি একটি গ্রুপের উপর বর্তায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতামত নয় বরং পুলিশের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে খুনি হিসেবে একটি গ্রুপ অভিযুক্ত হয়।
সংঘর্ষটি হয়েছিল হয়তো উপরের কোন মহলের ইশারায়। এতে জীবন গেল একজন সাধারণ ছাত্রের, খুনি হলো কিছু হল পর্যায়ের নেতা (যদিও খুন করেছিল পুলিশ)। ক্যাম্পাসে গ্রুপিং রাজনীতির নতুন মেরুকরণ হলো, অভিযুক্ত অধিকাংশ নেতার রাজনীতিরই ইতি ঘটে। কেউবা দীর্ঘদিন জেল খেটেছে। এখন সবাই তার নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্যে ছুটে চলছে নিজ নিজ ওয়ে-তে, কিন্তুু আবু বকর? তার পরিবার?
রণির বক্তব্য, আবু বকরদের জীবনের কোন মূল্য নেই। ওদের জন্মই যেন এই ভাবে মৃত্যুর জন্যে। ওদের মৃত্যুর কখনোই জাস্টিস হবে না। আজ হয়তো বেঁচে থাকলে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারতো, তার পরিবারের হাল ধরতো! কিন্তু সে আজ...
জানা গেছে, ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ১০ ছাত্রকে নামমাত্র সাময়িক বহিষ্কার করেই দায় সারে। আবু বকর ছিদ্দিক হত্যা মামলায় ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। শাহবাগ থানার দেওয়া অভিযোগপত্রে আটজনকে আসামি করা হয়েছিল। এর আগে ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের তখনকার হল শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান মোল্যা গ্রুপের সংঘর্ষের সময় তিনি আহত হন। মৃত্যুর দুই মাস পর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বকরের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। তাতে প্রথম হয়েছিলেন তিনি।
দীর্ঘ ১৪ মাস মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর ২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এতে ছাত্রলীগের স্যার এ এফ রহমান হল শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুককে প্রধান আসামি করে ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করা হয়।
মামলায় অভিযুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- এনামুল হক, মনসুর আহমেদ রনি, আবু জাফর মো. সালাম, মফিদুল ইসলাম খান, রকিব উদ্দিন, মেহেদী হাসান ও তৌহিদুল খান তুষার। আসামিদের সবাই হল ও ক্যাম্পাস ছেড়েছেন।
পড়ুন:স্বাধীনতার পর থেকে ঢাবি ক্যাম্পাসে যত লাশ
প্রসঙ্গত, টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ী গ্রামের দিনমজুর রুস্তম আলী ও রাবেয়া খাতুনের সন্তান আবু বকর। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারে প্রথমস্থান লাভকারী ছাত্র। থাকতেন স্যার এফ রহমান হলের ৪০৪ নম্বর কক্ষে।