ছাত্ররাজনীতির একাল সেকাল
- মো. আল আমিন
- প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:২৪ PM , আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৯, ০৭:৪৫ PM
ধরা যাক একজন কোমলমতি শিক্ষার্থী বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের কিছু বই পড়ছে। সেখানে সে হয়তো জানতে পারবে ৫২’র ভাষা আন্দোলনে পটভূমি। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় যখন ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তখন দলমত নির্বিশেষে সবার আগে মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ করেছিলো এই দেশের ছাত্রসমাজ। আর তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলো তখনকার ছাত্রনেতারা।
শুধু ভাষা আন্দোলন নয় এরপর বাঙ্গালী অধিকার আদায়ে যতগুলো আন্দোলন করেছে। তার নেতৃত্বের প্রথম সারিতে ছিলো এদেশের ছাত্রনেতারা। ছাত্র রাজনীতির গৌরবউজ্জ্বল ইতিহাসগুলো পড়ার মাঝে সেই কোমলমতি শিক্ষার্থী যখন টেলিভিশনের দিকে চোখ রাখলো, সে দেখতে পেলো বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে একমত হয়েছে শিক্ষকরা। সারা দেশে চলছে লেজুরবৃত্তির ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সমালোচনা।
সে শিক্ষার্থীর মতই সবাই হয়তো এখন ভাবতে শুরু করেছেন ঠিক কি কারণে গৌরবময় ছাত্র রাজনীতির প্রতি মানুষের এত ঘৃণা জন্মালো? চলুন জানা যাক, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির একাল সেকাল।
ছাত্র রাজনীতির সূচনা: ইন্টারনেট থেকে যতদূর জানা যায়, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার রাজনীতিতে ছাত্র রাজনীতি যোগ করে নতুন মাত্রা৷ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছাত্রদের সক্রিয় রাজনীতিতে পূর্ণতা পায় বিশ শতকে৷
তবে জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের মোটামুটি অংশগ্রহণ থাকলেও ১৯২৮ সালে আগে বাঙালি ছাত্রদের কোনো নিজস্ব সংগঠন ছিল না। তখন কংগ্রেসের উদ্যোগে নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি নামে ছাত্রদের একটি সংগঠন গঠিত হয়৷
তারই ধারাবহিকতায় ১৯৩০ সালের ১২ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুসলিম ছাত্রদের একটি সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শহীদুল্লাহ্কে একটি মুসলিম ছাত্র সমিতি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ১৯৩২ সালে নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়৷
স্বাধীনতার পূর্বের ছাত্ররাজনীতি: ১৯৪৭ এ দেশ ভাগে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির সূচনা হয়। বিশেষত ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর ঘোষণার পর ওই বছর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ গঠন করা হয়৷ এ বছরই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন এবং তাতে নেতৃত্ব দেয় ছাত্রদের এ সংগঠনটি৷ এ জাতীয় আন্দোলনে ছাত্রদের অবদান সুজ্ঞাত ও সর্বজনস্বীকৃত।
ওই সময়ে ভাষা সমস্যার সমাধান হলেও ছাত্র আন্দোলন থামেনি৷ তখনও প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল ও উপদল নিজস্ব ছাত্রফ্রন্ট গড়ে তুলতে চাইত। যার ফলে ১৯৫২ সালে পূর্ববাংলায় বাম রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন৷ তবে এটা স্পষ্ট ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতির এদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়৷
ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে ১৯৬৬ সালে ৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হলে ছয়দফা সমর্থন ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ছাত্রদের মধ্যে এক নজিরহীন ঐক্য গড়ে ওঠে৷ এ লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে সকল ছাত্রসংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাপুষ্ট ১১-দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে৷ পরিষদ গোড়ার দিকে ১১-দফা দাবির জন্য আন্দোলন করলেও পরবর্তীকালে ছাত্রনেতারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেন৷ ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এ প্রথম ছাত্রসমাজ একটি স্বাধীন অবস্থান অর্জন করে এবং নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মকান্ডের স্বাক্ষর রাখে।
১৯৭১ সালের ১ মার্চের পরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ তারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। পরদিন তারা পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা করে। একই সভায় ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। তারপরই শুরু হয় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে জনগণকে সংগঠিত করার এক উদ্যোগ। শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ।
ছয়দফা রাজনীতির আওতায় ২ মার্চ থেকে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন এতই ব্যাপক ও বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি এতটাই সম্মোহক হয়ে উঠেছিল যে তাতে ছয়দফা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে এক প্রতীকী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চের মধ্যরাতে জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণ ৩ মার্চ ছাত্রদের স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে। ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বস্ত্তত ৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণারই স্বীকৃতি। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রসংগঠনগুলোর বীরত্বপূর্ণ অবদান সর্বজনস্বীকৃত ও যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে৷
স্বাধীনতার পর ছাত্ররাজনীতি: যে ছাত্ররাজনীতির হাত ধরে এদেশের সাধারণ জনগণের স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ হয়েছিল। সে ছাত্র রাজনীতি অনেকটা খই হারিয়ে ফেলে স্বাধীনতার পর নেতৃত্বের বিভক্তির কারণে। আর এতেই গতি হারায় ছাত্র রাজনীতি। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগে আসে বিভক্তি৷ তৈরি হয় জাসদ ছাত্রলীগ৷
আর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় আসলে উল্টোপথে চলতে থাকে এদেশের সামগ্রিক রাজনীতি৷ সে সময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গঠিত হয় ছাত্রদল৷ সামরিক সরকারের ধর্মীয় রাজনীতি শুরুর অনুমতি পাওয়ার পর জামায়াত গড়ে তোলে তাদের ছাত্র সংগঠন শিবির৷
এরপর থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শুরু হয় শিবিরের সাথে অন্যদের সংঘর্ষ৷ আশির দশকটা সারা দেশের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষ চলতে থাকে৷ দিনের পর দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে৷
নেতৃত্বের বিভক্তির কারণে পথ হারানো সেই ছাত্র রাজনীতি অবশ্য আবারো গতি পায় স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ হটাও আন্দোলনে। সে সময় ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে গড়ে ওঠে এক অভাবনীয় ঐক্য। যার ফলস্রুতিতে পতন ঘটে এরশাদের। শুরু হয় গণতন্ত্রের পথ চলা।
নব্ববইয়ে এরশাদের পতনের পর থেকে এ দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে ভাবা হলেও ছাত্ররাজনীতি ঠিক ততটাই পিছিয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের নেতারা অনুধাবন করতে পারে ছাত্র রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ক্ষমতা গ্রহণ ও শাসনের পথ সহজ হবে। তারই ধারাবহিকতায় একদিকে তারা নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে ছাত্র রাজনীতির। অন্য দিকে ছাত্রসংগঠনগুলো ক্রমেই তাদের উপাঙ্গ হয়ে ওঠে, যার বড় কারণ হিসেবে ছাত্র সংসদ নির্বাচণ না দেয়াকে দায়ী করেন অনেকেই।
ছাত্র রাজনীতিকে বড় দলগুলো তাদের উপাঙ্গ ভাবার ফলে বেড়ে যায় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, সিট দখলের রাজনীতি, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের বাণিজ্য- ভর্তি, নির্মাণ, উপকরণ সরবরাহ ইত্যাদি শুরু হয়৷ প্রশাসনের নাগালের মধ্যে এগুলো ঘটলেও প্রশাসন রাজনৈতিক কারণেই হয়ে যায় নিশ্চুপ। ফলে বেপরোয়া হয়ে উঠে যে দল ক্ষমতায় থাকে অথাৎ ক্ষমতাশীন দলের ছাত্রনেতারা। হল গুলো হয়ে যায় টর্চারসেল। বাড়তে থাকে শিক্ষাঙ্গনে হত্যা কান্ড। যার সর্বশেষ শিকার বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার।
ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হওয়ার কারণ:এক সময়ের ঐতিহ্যময় ও গৌরবউজ্জ্বল ছাত্র রাজনীতি ধীরে ধীরে দলীয় প্রভাবে কলংকিতই হয়েছে। সর্বশেষ গত ২০ বছরে বাংলাদেশে যতগুলো ছাত্র আন্দোলন হয়েছে, তাতে ছাত্র নেতাদের অংশগ্রহন ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। বরং সে আন্দোলন দমন করতে সক্রিয় ছিলো ক্ষমতাসীন ছাত্র নেতারা।
ছাত্ররাজনীতির এই পতনের কারণ গুলো হতে পারে:
১. স্বাধীনতার পর জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের রাজনীতিতে মূল রাজনীতিবিদদের মত ছাত্র নেতাদেরও নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয়।
২. নব্বইয়ের পর থেকে ছাত্র সংগঠনগুলোর নির্বাচন না দেয়ার ফলে ছাত্র রাজনীতি অনেকটা বেকার হয়ে গেছে। নির্বাচন জিততে হলে ছাত্র নেতাদের সাধারণ ছাত্রদের কাছে আসতে হতো। নির্বাচণ বন্ধ হওয়ার পর ছাত্র নেতাদের সেই প্রয়োজনীয়তা না থাকায় ক্ষমতা বা পদ পেতে তারা দলের সাথে যোগাযোগ বাড়ায়।দলীয় নেতারা ছাড়া ছাত্রনেতাদের জবাবদিহিতার আর কোনো জায়গা তখন থাকে না৷
৩. অতীতে মেধাবী ও নিয়মিত ছাত্ররা রাজনীতি করতো এবং ছাত্রদের স্বার্থে কাজ করার একটা নৈতিকতা কাজ করতো। পরবর্তীতে পেশি শক্তির রাজনীতিতে মেধাবীরা অনেকটা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অনিয়মিত ছাত্ররা রাজনীতির দিকে ঝু্ঁকে পড়ে।
৪. রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে ছাত্র নেতাদের বেশি ব্যবহার করার ফলে তাদের নিয়ন্ত্রনেও অনেক সময় ছাড় দেয়া হয়।
৫. পদ পেতে কিংবা পদ ধরে রাখতে দলীয় লেজুরবৃত্তি বৃদ্ধি পাওয়া।
৬. রাজনীতিকে ব্যবহার করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। যার ফলে বেড়ে যায় চাঁদা বাজি, টেন্ডারবাজিসহ পেশি শক্তি প্রদর্শন।
নানাবিধ কারণে এখন ছাত্র রাজনীতি কুল হারিয়েছে। ছাত্র রাজনীতির উপর অনাস্থা এখন ছাত্র রাজনীতিকে নিষিদ্ধের দাবিকেও জোড়ালো করছে। তবে যে দেশের স্বাধীনতাসহ সকল আন্দোলনে ছাত্র রাজনীতির গৌরবউজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয় বরং জাতীয় রাজনীতিসহ সার্বিক রাজনীতিতে বড়সর সংস্কার দরকার। ডাকসু'র মত অন্যান্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়া এবং তা নিয়মিত করা। লেজুড়বৃত্তির চক্র থেকে বেড়িয়ে ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীর বদলে ছাত্রদের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। ছাত্র নেতাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে মূল দলকে। তবেই হয়তো সুদিন ফিরে পাবে বর্তমানে পথ হারা ছাত্র রাজনীতি। সমৃদ্ধ হবে জাতীয় রাজনীতি।