পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি ছাত্রলীগের ৩৪ জন, ডাকসু নেতা ৮
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৪৭ AM , আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৪৭ AM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদের আট নেতার ছাত্রত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা সবাই ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ায় নির্বাচনের কয়েকদিন আগে তারা ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের একটি সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হন। ভর্তির নীতিমালা অনুযায়ী লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল ওই কোর্সে ভর্তি হওয়া যায়। কিন্তু তাদের কেউই তাতে অংশ নেননি। ভর্তি হওয়া একাধিক ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর চলতি বছরের১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোসণার পর ছাত্রলীগের ৩৪ জন বর্তমান ও সাবেক নেতা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যাংকিং এন্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের মাস্টার্স অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হন। এই ৩৪ জনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও সদস্য পদে মোট আটজন নির্বাচনে অংশ নেন। তাদের মধ্যে বিজয়ী হন সাতজন। এছাড়া দুটি হল সংসদের ভিপি পদে অংশ নেন দুজন। এরমধ্যে একজন নির্বাচিত হন এবং অন্যজন পরাজিত হন। আরেকজন ছিলেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য।
সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রামের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রথমে ভর্তির বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হবে। বিজ্ঞাপন অনুযায়ী নির্ধারিত আবেদনপত্রের মাধ্যমে ভর্তির জন্য আবেদন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে আবেদন করা যাবে। আবেদনকারীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। এসব পরীক্ষার ফল, আগের একাডেমিক ফলাফল ও কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে সমন্বিত ফলাফল তৈরি করা হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে যৌথভাবে দুই বছর মেয়াদি এই প্রোগ্রাম চালু হয় ২০১৭ সালে। ডাকসু নির্বাচনের আগে এই প্রোগ্রামের সর্বশেষ ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে। ৩০ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয় জানুয়ারিতে। আর এই ৩৪ শিক্ষার্থী ভর্তি হন ১১ ফেব্রয়ারি ডাকসুর তফসিল ঘোষণার পর।
২০১৮ সালের নভেম্বরে ভর্তি পরীক্ষার সময় এই প্রোগ্রামের পরিচালক ছিলেন ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম (পরে ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ হন), সহকারী পরিচালক ছিলেন আবদুল্লাহ আল মাসুদ ও চেয়ারম্যান ছিলেন আবু তালেব।
এবিষয়ে আবদুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, নভেম্বরে জারি হওয়া ভর্তি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া জানুয়ারি মাসেই শেষ হয়। ডাকসু নির্বাচনের আগে ৩৪ জন শিক্ষার্থীর ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি তার জানা নেই। নিয়ম মেনে কেউ ভর্তি হয়ে থাকলে কমিটির সদস্য হিসেবে বিষয়টি তার জানার কথা।
মাস্টার্স অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট কোর্সের পরিচালকের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ওই সময় তিনি দায়িত্বে ছিলেন না। তবে, পরীক্ষা ছাড়া কেউ ভর্তি হয়ে থাকলে তা অনিয়ম।
এই প্রোগ্রামের পরিচালক ও অফিস সহকারী পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে, ছাত্রলীগের এই নেতাদের নামের তালিকা পাওয়া যায় ডাকসুর হল ভিত্তিক ভোটার তালিকায়। ভোটার তালিকায় এসব ছাত্রের নামের পাশে বিভাগের জায়গায় কোথাও ব্যাংকিং এন্ড ইনস্যুরেন্স, কোথাও এমটিএম (মাস্টার্স অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট উল্লেখ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাস্টার্স অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের একজন অফিস সহকারী বলেন, তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রলীগ নেতারা উপাচার্য বা ডিনের সই করা চিরকুট তাদের কাছে নিয়ে আসেন। এরই ভিত্তিতে তাদের ভর্তি ফরম ও টাকা জমা দেয়ার রশিদ সরবরাহ করা হয়। ওই প্রোগ্রামের একাধিক শিক্ষক বলেন, ভর্তির পর এই নেতাদের কেউই ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশ নেননি। হাজিরা খাতায় এই নেতাদের নামও নেই।
ডাকসুর যেসব নেতার ভর্তি নিয়ে প্রশ্ন:
ওই প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য ছাত্রলীগ নেতাদের অনেকেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। তাদের অনেকেরই প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রত্ব। তারা উপাচার্য ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিনের সাথে যোগাযোগ করেন।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন মো. রাকিবুল হাসান (শিক্ষাবর্ষ ২০০৯-১০)। ছাত্রলীগের বিগত কমিটির কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন তিনি। তিনি ওই প্রোগ্রামের কোন ব্যাচের সদস্য তা জানতে চাইলে বলতে পারেননি তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে রাকিবুল বলেন, ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হয়েছেন। তিনি অনুষদের ডিন বরাবর আবেদন করেছিলেন। সদস্য পদে বিজয়ী নজরুল ইসলামও ছিলেন ইতিহাস বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি তিনি। নজরুল ইসলাম বলেন, ভর্তি হতে তাকে পরীক্ষা দিতে হয়নি। উপাচার্য বরাবর আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদন পরবর্তীতে ডিন ও প্রোগ্রাম পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়। ডাকসুর সদস্য মুসা, মাহমুদুল হাসানও পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
তবে, ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তির বিষয়টি স্বীকার করেননি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মো. আরিফ ইবনে আলী (শিক্ষাবর্ষ ২০১০-১১) এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কায়েস চৌধুরী (শিক্ষাবর্ষ ২০১১-১২)। তারা ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হয়েছেন বলে দাবি করেন। এবিষয়ে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি ক্রীড়া সম্পাদক শাকিল আহমেদ তানভীর (শিক্ষাবর্ষ ২০০৯-১০)। তবে, এই তিনজনও ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন ডাকসুর সদস্য নিপু ইসলাম। শামসুন্নাহার হল ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি বলেন, তিনি, আরিফ, শাকিল, নজরুল ও তানভীর একসাথেই ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের কাউকেই পরীক্ষা দিতে হয়নি।
এই সাতজনের বাইরেও ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক পদে প্রতীদ্বন্দ্বীতা করে হেরেছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপ ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল হক সরকার। ফজলুল হক হল সংসদের সহ সভাপতি পদে নির্বাচন করে হেরেছেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহরিয়ার সিদ্দিক। এফ রহমান হলের ভিপি পদে জয়ী হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম খান। এই তিনজনও ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই ওই প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছিলেন। আর একইভাবে ভর্তি হওয়া প্রদীপ চৌধুরী ছিলেন ডাকসুর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
ভর্তি হয়েও যারা নির্বাচন করেননি:
পরীক্ষা না দিয়েই ভর্তি হওয়া ৩৪ জনের মধ্যে ২৩ জন ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেননি। এদের সকলেরই ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে ১ থেকে ৫ বছর আগে। এই তালিকায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে রয়েছেন, সহ সভাপতি আওলাদ খান, আমিনুল ইসলাম, ইশরাত কাশফিয়া, সোহেল মিয়া ও ফুয়াদ রহমান খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজির হোসাইন, সাংগঠনিক সম্পাদক সোহানুর রহমান, দপ্তর সম্পাদক আহসান হাবীব, আইন সম্পাদক ফুয়াদ হোসেন, অর্থ সম্পাদক রাকিব হোসাইন, উপতথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আব্দুল জাব্বার, উপ অর্থ বিষয়ক সম্পাদক বোরহান উদ্দিন, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক হায়দার মো. জিতু, উপ সাহিত্য সম্পাদক শরিফুল ইসলাম, শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস, জসিমউদ্দিন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহেদ খান ইয়াকুব, শামসুন্নাহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জিয়াসমিন শান্তাও এই প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছেন।
এছাড়া সাবেক নেতাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি অদিতা নন্দী, মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক আল মামুন, জিয়া হল ছাত্রলীগের সহ সভাপতি ইমরান খান, আইন অনুষদের সাবেক সভাপতি শরিফুল হাসান ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোতাহার হোসাইন ভর্তি হন।
যা বললেন ডিন ও উপাচার্য:
পরীক্ষা ছাড়া ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ভর্তির বিষয়ে তাঁর জানা আছে। ওই প্রোগ্রামটি সান্ধ্যকালীন হওয়ায় ভর্তির প্রক্রিয়াটি তাঁর জানা নেই। তিনি এ বিষয়ে অনুষদের ডিনের সাথে কথা বলতে বলেন।
তবে, অনুষদের ডিন প্রতিবেদককে বলেন, আপনি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে খোঁজখবর করছেন। আপনি ডাকসুর যেসব নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন তারাও আমার কাছে এসেছিল। আপনি তাদের কাছে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করেছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব না।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটার্স অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরৗ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যায়ভাবে কেউ ভর্তি হয়ে থাকলে এর সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে। এছাড়া, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এধরনের ঘটনা না ঘটে।
সুত্র: প্রথম আলো