শামসুন নাহার হল থেকে ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার রোমহর্ষক বর্ণনা
- শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি
- প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৯, ০৮:২৮ PM , আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৫৯ PM
১৪ই আগস্ট, ২০১৮। সন্ধ্যা সাতটা পনেরো কি বিশ বাজে ঘড়িতে। মাত্র গোসল করে বেরিয়েছি। এসেই দেখি পরমা খবিশটার ফোন। চা খাবেন তিনি। সেদিন আমার কপালে অন্যকিছু লেখা ছিল বলেই কিনা জানিনা, শয়তানটা একেবারে অস্থির হয়ে গিয়েছিল চা খাওয়ার জন্য। তাড়া দিচ্ছিল, চুলটাও ভালোমতো শুকায়ে নিতে পারিনি। তড়িঘড়ি করে নিচে নামলাম। ম্যাডাম প্রোভোস্ট অফিসের সামনের চেয়ারে বসা। গেলাম চা খাইতে। তিনি আরও কিছু খাবার বায়না ধরলেন।
আমাকে আব্বু সপ্তাহে সপ্তাহে টাকা দেয়, সেদিন একেবারেই টাকা ছিলনা কাছে। পার্সে ইয়ারফোন আর মোবাইলটা ছিল শুধু। হান্নান মামার দোকানে গিয়ে বসলাম। মামাকে চা দিতে বললাম মামা চা বানায়েও সারতে পারেনি। এরমধ্যে পাঁচ সাতজন লোক তেড়ে আসলো আমাদের দিকে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো আমি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি কিনা। আমি বললাম হ্যাঁ। তারা তাদের আইডি কার্ড বের করে পরিচয় দিল। ডিবি থেকে এসেছে। তাদের স্যার আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমাকে নিয়ে যেতে চাইলো। আমি বললাম এরেস্ট ওয়ারেন্ট কোথায়? কেন নেয়া হবে আমাকে। এর মধ্যেই দু'জন মহিলা আমার দুই হাত ধরে জোরে হ্যাচকা টান দিল। এত আকষ্মিকভাবে ঘটনা ঘটে চলেছে, আমি যেন কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম।
পরমা বললো, জিজ্ঞাসাবাদই যখন করা হবে, ও আমার সাথে যাবে। ওরা বললো ঠিক আছে। আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। রাস্তা পার হয়ে টিএসসির পাশে পার্ক করা একটা মাইক্রোতে তুললো আমাকে। আমি অসহায়ের মতন পরমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওকে ওরা নিল না। আমাকেই নিয়ে গেল শুধু। আমি গাড়িতে বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম আমার কি অপরাধ? আমাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাকে বলা হলো সেটা গেলেই টের পাব আমি। পুলিশকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছি, স্ট্যাটাস দিয়েছি ফেসবুকে। তখন কেন আমার মনে ছিল না। ওরা কি আসলেই ডিবি নাকি আমাকে অপহরণ করা হয়েছে তখনও আমি নিশ্চিত ছিলাম না। আমি হাউমাউ করে কাঁদছি।
- আমাকে এভাবে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? আমি কি করেছি? আমি একটা ভালো ঘরের মেয়ে।
- গেলেই সবকিছু বুঝতে পারবেন।
- গুম করে ফেলবেন আমাকে?
- বললাম ত গেলেই সবকিছু বুঝতে পারবেন।
- নওশাবা আপুর মতো কিছু কি করবেন আমার সাথে?
- (তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে) কেন? আপনি নওশাবার মতন কিছু করসেন? করে থাকলে করা হবে।
ড্রাইভারটা যেন বুনো উল্লাসে মেতেছিল। এত দ্রুত চালাচ্ছিল, যারা গাড়িতে ছিল, তারাই নিষেধ করছিল ওকে এমন করতে। সম্ভবত আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য এরকম করছিল। দেখে মনে হচ্ছিল খুব মজা পাচ্ছে সে এইকাজ করে।
তো ডিবির হেডকোয়ার্টাসে গাড়ি এসে থামলো। নামানো হলো আমাকে গাড়ি থেকে। আশেপাশের সবাই যেন কৌতুহল আর বিদ্রুপ নিয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। ভাসা ভাসা কিছু মন্তব্যও কানে আসছিল। (এ তো এইবার বিশাল বড় নেত্রী হবে.. আরও কি কি যেন)। আমাকে একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সম্ভবত সেটা এএসপির রুম ছিল। আমি আর পুলিশের তিনজন নারী সদস্য, আর কেউ ছিলনা সেখানে। বাইরে একদল লোক টিভিতে কি যেন দেখছিল। আমাকে প্রায় ঘন্টাখানেকের বেশি সেখানে বসিয়ে রাখা হলো। সাথে সেই তিনজন নারী। নানারকম বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করছিল শুরুতে। আমি নির্বিকার হয়ে শুধু চোখের পানি ফেলছিলাম।
তারপর এককথা, দুই কথা জিজ্ঞেস করলো। আস্তে আস্তে দেখলাম ওদের ব্যবহার কিছুটা নরম হয়ে এলো। কোথায় বাড়ি, কোন বিভাগে পড়ি, কয় ভাইবোন এইসব আরকি। সেই রাতের বেলা এরকম অপরিচিত ভয়ঙ্কর একটা জায়গায় ওই তিনজনের উপর আমি পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে গেলাম যেন। কাঁদতে কাঁদতে এইদিকে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোর। ওয়াশরুমে গেলাম। অনেকক্ষণ ধরে পানির ঝাপটা দিলাম মুখে। বারবার ভাবতে চাইলাম স্বপ্ন দেখতেসি। এরকম কিছু আসলে ঘটেনি আমার সাথে। কিন্ত দরজার ঠকঠক, পানির স্পর্শ, সবকিছু চিৎকার করে কানের কাছে বলতে লাগলো আজ রাতই হয়তো হতে পারে আমার জীবনের শেষ রাত।
তো যাই হোক, তাড়া দিতে থাকলো, আমার ডাক এসেছে। পেটে আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু পড়েনি। নুডুলস রান্না করসিলাম, রুমে যেয়ে খাব দেখে। তা আর হলো কই! আমাকে নিয়ে যাবার সময় টের পেলাম আমার শরীর চলছে না। সামনে দুইজন আর আমার সাথে সেই তিনজন নারী। অসহায়ের মতন বললাম হাঁটতে পারতেসি না। একজন এগিয়ে আসলো। আমাকে ধরে বললো আমার উপর ভর দিয়ে হাঁটেন। আমি প্রথমে ভয় পেয়ে গেসিলাম, আবার বোধহয় আগের মতন হ্যাচকা টান মারবে, কিন্ত না। তার মধ্যে আন্তরিকতা ছিল, মমতা ছিল। আমরা হাঁটতে লাগলাম। আমাকে যেখানে নিয়ে আসা হলো, সেখানে চারপাশ দিয়ে অনেকগুলো চেয়ারে অনেকজন বসা, আমি অনেকটা মাঝখানে। আমি কেঁদে দিলাম। ওই তিনজন নারীকে বললাম যেন আমাকে ছেড়ে না যায়। কিন্ত তারা আমাকে আশ্বাস দিয়ে বসিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসলো।
আমার অস্বস্তি লাগতে লাগলো। চা আর বিস্কুট সাধলো। রাত তখন প্রায় দশটা৷ এত রাতে এভাবে ধরে নিয়ে এসে এরকম আলগা পিরিত দেখে আমার গা জ্বলে গেল। আমার নাম, বাবার নাম, পরিচয়, রাজনৈতিক অবস্থান সবকিছু খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। এক এক প্রশ্ন দুই তিনবার করে করছে, আমার আরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এরমধ্যে আবার সাইড টক করে মজা নিচ্ছিল। আর কন্ট্রোল করতে পারলাম না। চিল্লায়ে বলে উঠলাম, আপনারাই যদি এভাবে ইভ টিজিং করতে থাকেন, তাহলে বাকিরা কই যাবে??? ওরা মনেহয় এরকম কোনো সিচুয়েশনের জন্য প্রস্তত ছিলনা। থতমত খেয়ে গেল যে লোকটা বেশি বাড়াবাড়ি করতেসিল সে। আমি কি কি বলছিলাম, সবকিছু স্পষ্ট মনে নেই। সেখান থেকে আরেক রুমে নিয়ে যাবার আগে বারবার করে বলে দিল সেখানে গিয়ে যেন মাথা গরম না করি। সেখান থেকে বেরিয়ে আরেক জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
এবার যে রুমে আনা হলো, তিনি সম্ভবত এডিসি ছিলেন। একজন নারী। আমাকে বসতে বললো। আমার থেকে এতক্ষণ যা যা জিজ্ঞেস করে লিখেছিল, তা তার হাতে। সে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়তে লাগলো। লাস্টে লেখা আমি বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত। আমি বললাম আমি বাম রাজনীতি করিনা। তারপর জিজ্ঞেস করলো, এসব পোস্ট কেন দিয়েছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন পোস্টে কি সমস্যা, তারপর কয়েকটা পোস্টের প্রসঙ্গ এলো। আমি আমার মত করে উত্তর দিলাম। "দমন পীড়ন করে কি বাল্ডা ফেলাতে পারবেন..." শিরোনামে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। তার ব্যাখ্যা চাইলো। আমি উত্তর দিলাম। তারপর আমাকে ধমকের সুরেই বললেন আমার এসব কেন করতে হবে? সরকারি চাকরি করতে চাই কিনা, জিজ্ঞেস করলো। আমি উত্তর দিলাম, না। এবার বোধহয় রেগে গেলেন উনি। বলতে শুরু করলেন এই বামের মেয়েগুলো সবগুলো একরকম। ছাত্রলীগের মেয়েরা কথা বললে বোঝে। ছাত্রদলের মেয়েরাও নাকি বামদের মতন না। এরা সবসময় নাকি দুই লাইন বেশি বোঝে।
আমি বললাম আমার চাকরি হবেনা দেখে করব না। আমার যেন চাকরি না হয়, সেজন্যই তো আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন তো কোন প্রাইভেট জবও পাবনা আমি। আমি মুখ দেখাতে পারব না কাওকে। আত্মহত্যা করা ছাড়া আপাতত আমি সামনে আর কোনো উপায় দেখতেসি না। এবার তিনি একটু নরম হলেন। বোঝাতে চেষ্টা করলেন আমাকে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পাশ করেছে, বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, মেডিকেলে চান্স পেয়েও ঢাকার বাইরে যেতে চাননি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তিনি নাকি নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যাতে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের গায়ে তার হাত না দেয়া লাগে। আরও অনেক কথাই বলেছিলেন, সবকিছু আপাতত মনে নেই। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছিলেন। তার কাজ ভাড়াটে গুন্ডারা করে দিয়েছিল সেই রাতে। রক্তে ভেসে গিয়েছিল ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি... আমি নির্বিকারের মতন শুধু শুনেই গেলাম। ঠিক কি কারণে আমি সেইসময় নরক জাতীয় একটা পরিস্থির মধ্যে ছিলাম, তা তখনো আমার কাছে পরিস্কার নয়। যাই হোক, অনেক কথাই বললেন তিনি। বাইরে থেকে ওই তিন নারী সদস্যকে ডেকে বললেন ওকে নিয়ে যাও। আমি ভাবলাম এবার বোধহয় হলে যেতে পারব আমি।
আমাকে একটা গাড়িতে তুললো। আমি কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ভাবলাম হলে যাচ্ছি অবশেষে। ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা মতন বাজে৷ কিন্ত গাড়ি যখন আরেকদিকে গেলো, আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম আমি হলে যাচ্ছিনা? উনি যে বললেন আমাকে নিয়ে যেতে??? গাড়ি এইদিকে কেন যাচ্ছে??? আমাকে ধমক দিয়ে বলা হলো, এত তাড়াতাড়ি? ছাড়া পাইতে কয়মাস লাগে, তার কোনো ঠিক নাই। আমার তখন আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করলো না। আমাকে লিফটে করে কত তলায় যেন নিয়ে গেল। এবার যার রুমে গেলাম তিনিও এডিসি। তার ব্যবহার সন্ধ্যা পর্যন্ত যতজনের সাথে কথা হয়েছিল, তারমধ্যে সবচাইতে রুড ছিল। রুমে আমাকে একা ডাকা হয়েছিল। আমি বারবার অসহায়ের মতন মহিলা পুলিশ তিনজনের দিকে তাকাতে লাগলাম।
আমাকে দেখেই ভেঙচি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো তুমিই তাহলে সেই মেয়ে! এইগুলা কি করসো তুমি? কোন দলের রাজনীতি করসো? কোন কোন সংগঠন করো?
আমি বললাম আমি এক্টিভ পলিটিক্সের সাথে জড়িত না, তবে আওয়ামীলীগ সাপোর্ট করি। আমার ফেমিলির সবাই তাই করে। আমি স্লোগান '৭১ এর সেক্রেটারি ছিলাম। বাঁধন, শামসুন নাহার হল ইউনিটের প্রেসিডেন্ট ছিলাম।
- তোমাকে না স্লোগান' ৭১ থেকে বের করে দিসিল?
- ওরা এরকম একটা নোটিশ দিয়েছিল। তারপর শুনেছি সিনিয়ররা এটা সলভ করেছিলেন।
- কেন এইকাজ করসিল তুমি জানার চেষ্টা করোনি?
- ওরা আমার সাইনে কমিটিতে আসছিল। ওদের কাছ থেকে এরকম আচরণে হতাশ হয়েছিলাম। আর যোগযোগ করবার রুচি হয়নি।
তারপর সে একটা বিদ্রুপাত্মক হাসি দিল। আর কোনো কথা হয়নি তার সাথে আমার। সময় গড়িয়ে চলছে। প্রায় আধাঘন্টা আমাকে তার রুমে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। আমার মাথায় তখন সেদিন শেষ ছয় মারমা পরিবার উচ্ছেদের নিউজটা বারবার ঘুরছিল আর হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোঁপাতে লাগলাম। আধঘন্টা পরে একজনকে বললো আমাকে নিয়ে যেতে৷ আর আমার আইডি যেন ডাউনলোড করা হয়। সেখান থেকে পাশের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানেও বিশ মিনিটের উপর বসিয়ে রাখা হলো কোনো কারণ ছাড়াই। রাত বেড়ে চলছে। আমাকে এরপর ডেকে আমার ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড, ইমেইল একাউন্ট, ইন্সটাগ্রাম সবকিছু নেয়া হলো। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকসুবিধা ভোগ করার সৌভাগ্যে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার তখন। এরপর সেখান থেকে আবার প্রথমে যে রুমটাতে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। আকাশ কাঁদছিল তখন। ভিজে গিয়েছিলাম খানিকটা। ঘড়িতে সম্ভবত তখন একটা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। আমার সাথে যারা ছিল সবার মন খারাপ, অস্থির তারা।
একজনের ফোন এলো। তিনি এস আই ছিলেন। বাসা থেকে ছেলে ফোন দিয়েছে বাবা ফিরছেনা দেখে। ছেলেকে বুঝিয়ে ফোন রেখে লোকটা অসহায়ের মতন দাঁড়িয়ে রইলো। আমার সাথে থাকা তিনজন নারীর একজনের ঘরে বিশ মাসের বাচ্চা। এইকথা বলার সময় প্রায় কেঁদে দিল সে। আরেকজনের মাত্র আড়াইমাস আগে বিয়ে হয়েছে। স্বামী বারবার ফোন দিচ্ছে বাসা থেকে। টেনশন করছে। আরেকজনের বাসা থেকেও বারবার ফোন। সবার মন খারাপ। আমার নিজেকে অভিশপ্ত মনে হচ্ছিল তখন। আমার কারণে এতগুলো মানুষ কষ্ট পাচ্ছে এত রাত পর্যন্ত। আমি কেঁদেই চলেছি। ওরাও হয়তো বুঝেছিল আমার গিলটি ফিল হচ্ছিল। তো কথায় কথায়ই কোন ডিসি স্যারের খুব প্রশংসা করছিল তারা। সে নাকি অনেক দায়িত্বশীল, সব ছোটখাটো বিষয় খেয়াল করে, ব্যবহার অনেক ভালো। এতক্ষণে আমার সাথে যে ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষ করে লাস্টের জন যে বদান্যতা দেখিয়েছেন, তাতে পুলিশ শব্দটাই ট্রমা মনে হতে শুরু হলো আমার। আগের থেকেই এদের দেখতে পারতাম না, এর উপর আবার এতরাত পর্যন্ত বাইরে। আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। এরপর আমাকে সেই রুম থেকে আবার আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। এবার ডিসির রুমে।
মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। খুব সুন্দর করে বসতে বললো। বসলাম। চা নিয়ে আসতে বললো। আমি পানি চাইলাম। সে বললো এত রাত পর্যন্ত সচরাচর সে অফিসে থাকেনা৷ আজকে শুধু আমার জন্য আছে। চা খাইয়ে তারপর কথা শুরু করতে চাইলেন। আমি কিছুতেই খাব না। আমি বললাম এতক্ষণ পর্যন্ত আমার সাথে যে ব্যবহার করা হয়েছে, এরপর আর একগ্লাস পানি খাওয়ার মতনও মেন্টালিটি নেই আমার। তিনি বাকিদের জিজ্ঞেস করলেন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার কে করেছে? তিনি আবারও চা খেতে বললেন। আমি নিলাম না। সে বললো তার রুম থেকে খালিমুখে কেউ যায়না, সে কষ্ট পাবে আমি কিছু না খেলে। আমার কানে সব কথাই তখন বিষের মতন লাগছে। আমি মানুষটার উপর এই ছয় ঘন্টায় যে ক্ষোভের পাহাড় আমার মধ্যে জমে ছিল সব উগরে দিলাম। সে বিব্রত এবং অসহায়, তা তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল। সে আমাকে বারবার এটাই বোঝাতে চেষ্টা করলো আমি যেন পুলিশকে নিজের প্রতিপক্ষ না ভাবি। আমি তর্ক করতেই থাকলাম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তাদের মহত্ব তো আমার নিজের চোখে দেখা। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়েও বাচ্চাগুলোকে পর্যন্ত ছাড় দেয়নি ওরা।
লোকটা আমাকে শান্ত করবার চেষ্টা করলো। সে নিজেও চাকরিতে ঢোকার আগে পুলিশ দেখতে পারত না, তাও বললো। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলো। তার মাও পুলিশ দেখতে পারত না, পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের সময় যখন তার বাড়ি এক মা হারা পুলিশ গিয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল আর তারপর তার মায়ের পুলিশ সম্পর্কে ধারণা আস্তে আস্তে বদলে গিয়েছিল, সেই গল্পও শোনাল। তার ধৈর্য আর বিচক্ষণতা দেখে আমি আস্তে আস্তে শান্ত হলাম। এতক্ষণ যা তুলকালাম করলাম, তার জন্য আমার নিজের উপর রাগ উঠতে লাগলো। তো সবশেষে সে আমাকে বললো ভবিষ্যতে এমনটা আর না করতে। আমাকে হলে রেখে আসা হবে এখন, সেটাও আশ্বস্ত করলো। আমি তার রুম থেকে বের হবার আগে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
আবার সেই প্রথম রুমটাতে নিয়ে আসা হলো আমাকে। আমি অস্থির হয়ে গেলাম। আমাকে বললো হলে রেখে আসবে তাহলে আবার এখানে কেন এনেছে??? তারপর আমাকে বলা হলো ওরা আমাকে শাহবাগ থানায় আমার হাউজ টিউটরের কাছে হ্যান্ডওভার করবে। আমাকে এখান থেকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। এর আগে কাগজে লিখে দিতে হবে আমি এরকমকিছু করব না। পরে জানতে পেরেছিলাম অবশ্য, দাপ্তরিক ভাষায় একে মুচলেকা বলে।
সে যাইহোক, আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো শাহবাগ থানায়। বসে আবার অপেক্ষা! আমি রাগের চোটে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমাকে ধমক দিয়ে বসানো হলো। আমার হাউস টিউটর ম্যাম, এসিস্ট্যান্ট প্রোক্টর থানায় আসলেন। ওসি সাহেবের খোঁজ নেই! তিনি আসলেন আরও মিনিট কুড়ি পরে। রাত প্রায় দুইটা তখন। এর আগের রাতেও ঘুমাতে পারিনি পরীক্ষার কারণে। ওইদিন সেই সময় আমার বমি বমি পাচ্ছিল। দুপুরের পরে আর পেটে কিছু যায়নি তো, তাই আরকি! অবশ্য এতক্ষণ আমি টেরও পাইনি, কখন আমার ক্ষিদেতে পেট জ্বলা শুরু হয়েছে। তখন টের পেলাম। বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছিল। বসে টেবিলের সাথে চোখ বন্ধ করে মাথা ঠেকিয়ে রাখলাম। ওসি আসার পর আমার হাউজ টিউটর ডিবির কাছে সাইন করে আমাকে বুঝে নিল। এরপর ডিবির লোকজন ফিরে গেল৷ যাবার সময় ওই তিন নারীর একজন, যিনি ঘরে বিশ মাসের বাচ্চা রেখে এতক্ষণ আমার সাথে ছিলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় নিল। ভালো থাকতে বললো আমাকে। একই হাতে একজন পেশাজীবী পুলিশের খাবলে ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া থেকে একজন মায়ের মমতার স্পর্শ পেলাম। কি লীলা বিধাতার!
১৫ আগস্ট ক্যালেন্ডারে তখন। আমি সারাজীবন ক্ষত ঝরানোর মতন একটা রাত পেলাম। ভালো মন্দ জানিনা, শোক দিবসে সত্যিকারের শোক পালন কয়জন আর করে, নিজেকে এসব বুঝিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম।
শামসুন নাহার হল থেকে ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার রোমহর্ষক বর্ণনা দ্বিতীয় পর্ব
ডিবির সবাই চলে গেল। ওসি আমাদেরকে কফি দিতে বললেন। আমি মানা করে দিলাম। কফি গেলার মতন মানসিক অবস্থা তো ছিলই না, আগের রাতে না ঘুমানোর কারণে টানা চল্লিশ ঘন্টার উপরে জেগে থেকে শরীরও চলছিল না। তার উপর আবার দুপুর থেকে না খাওয়া, খালিপেটে কফি খেতামই বা কিভাবে? ম্যামকে ঘটনা খুলে বললাম। কিন্ত ওসি মহাশয়ের দরদ বেয়ে বেয়ে পড়ছিল। তিনি বললেন, কফি না নিলে ধরে নেব আপনি এখনো রাগ করে আছেন।
আমি নিজের ধৈর্য দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। যে মেয়ে সামান্য কথাতেই রেগেমেগে একাকার হয়ে যায়, সেই মেয়েটা এরকম বীভৎস একটা উপহাসে জাস্ট নির্বিকার রয়ে গেলো। আসলে আমার স্নায়ুগুলো আর পেরে উঠছিল না। এর আগে এত বেশি চাপ ওদের ওপর দিয়ে যায়নি তো কখনো, তাই আরকি। শান্তভাবে জাস্ট উত্তর দিলাম, খুশি হওয়ার মতন কিছু তো ঘটেনাই৷ উত্তর শুনে ওসির মুখ কালো হয়ে গেল।
আমি হলে যাবার জন্য অস্থির হয়ে গেলাম। গায়ের জামাটা ছেঁড়া, ট্রাউজারটাও পুরোনো। পায়ে স্পঞ্জের জুতো। ওই অবস্থায় আমাকে নির্যাতিত কোনো কাজের মেয়ে ভেবে যে কেউই কনফিউজড হয়ে যেত আমি নিশ্চিত। ম্যাম বললো হলে যাওয়া যাবে না। আমি আর নিতে পারতেসিলাম না। শান্তভাবেই জিজ্ঞেস করলাম কেন যাবনা? মামলা তো দেয়নি, ছেড়েও দিয়েছে। তাহলে হলে যেতে অসুবিধা কোথায়। কাঁদার মতন শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই আমার মাঝে। তবুও চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগলো। আমার ছেঁড়া জামা, জুতার কথা বললাম এতগুলো লোকের সামনে। এই অবস্থায় এতরাতে আমি কোথায় যাব। আর তাছাড়া আমাকে রেখে গিয়েছে হল প্রশাসনের জিম্মায়, আমাকে বলেছেও যে হলেই যাব আমি, কিন্ত না। মামাকে ফোন দেয়া হয়েছে। রাত সোয়া দুইটা তখন। আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। বললাম মামার বাসায় যাব না, হলে যাব। আমার কথা কোনোভাবেই মানলেন না ম্যাম। কম করে হলেও দশবার রিকোয়েস্ট করেছিলাম। শেষমেশ না পেরে বললাম, আমি এককাপড়ে কই যাব এখন? অন্তত দশটা মিনিটের জন্য যাইতে দেন। আমার জামাটা ছেঁড়া, ঈদের আগে তো আর আসা হবেনা। আমি কয়টা জামাকাপড় নিয়ে আসি। ম্যাম তাতেও রাজি হলেন না। কোনোভাবেই আমি এখন হলে যেতে পারব না। সকালে আমার আব্বু হলে এসে ব্যাগ নিয়ে যাবে। আর আমার রুমমেটরা জামাকাপড় দিয়ে দেবে।
আমার মাথায় এবার রক্ত উঠে গেল। আমি বলতে শুরু করলাম, আমাকে ছেড়ে দেবার পরেও এই নাটক কেন করতেসে। আর ডিবি তো আপনার কাছেই দিয়েছে, আমার মামার কাছে তো দেয়নি। তাহলে আমি আমার মামার সাথে কেন যাব? আমি হলে যেতে চাইলাম তাও দিলেন না, এখন মাত্র দশটা মিনিট সময় চাচ্ছি, তাও কেন দিবেন না? রড, রামদা, হকিস্টিক আলাদের তো দুধেভাতে পালতেসেন, বিভিন্ন চ্যানেলে তাদের কৃতকর্মের ফুটেজ থাকার পরেও তাদের আদর করে হলে রেখে তোষণ করে পালতেসেন, আমি ছাড়া পাবার পরেও কেন হলে যেতে পারব না? সবার মাথা নিচু। কোনো উত্তর নেই। ওসিও বিব্রত। আমি ওসিকে বললাম, আপনি তো শাহবাগ থানার ওসি। আপনি ব্যবস্থা নেন না কেন এদের বিরুদ্ধে। এরা যে হলে অস্ত্র নিয়ে থাকে তা তো ওপেন সিক্রেট। অনেক, অনেক প্রমাণ আছে এদের অপকর্মের। তামশা দেখেন কেন? সে সাফ জানিয়ে দিল এটা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাকে হলে থাকতে দেবে কি দেবেনা, সেটাও। এটা নিয়ে সে কোনো মন্তব্য করবে না।
আমি এবার বললাম, তার চাইতে হাতে ইয়াবা ধরায়ে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেন আমাকে। আপনারা তো করেন এইগুলা। আমাকে মুক্তি দিয়ে দেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারণে আমার বিশ্ববিদ্যালয়, আমার রাষ্ট্র আমাকে যে প্রতিদান দিয়েছে, আমি আর নিতে পারতেসি না। আমাকে মুক্তি দিয়ে দেন। সে বললো, প্রমাণ ছাড়া নাকি কখনো ক্রসফায়ার দেয়া হয়না। আমি কক্সবাজারের একরামের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বেচারার মুখ আবার কালো হয়ে গেল। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। সবাই নিশ্চুপ বসে আছে মাথা নিচু করে। আমি কাঁদছি।
এরমধ্যে মামা চলে আসলো। সাথে সুমন ভাইয়া। এবার আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের বুলি ফুটলো। তারা খুব মহৎ কাজ করেছেন, এত রাতে আমার জন্য থানায় এসে কতবড় দয়া আমাদের উপর করেছেন, মামাকে বলতে লাগলেন। মামাও আক্ষেপ করে বললেন, আমি মেয়ে না হলে এতরাতে নাকি তিনিও আসতেন না। আমার লোকাল গার্জিয়ান হবার মাশুল সারাটা জীবন দিয়ে গেল মানুষটা। আমার কারণে রাত নেই, দিন নেই, সময় নেই, অসময় নেই, বিভিন্ন সময়ে তলব করা হয়েছে তাকে। আমি অপরাধবোধে কুঁকড়ে গেলাম। মামাকে বললাম এত রাতে কেন মামা আসছে, আমাকে হলের জিম্মায় দিয়ে গেছে, আমি হলে যাব। মামা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন আমাকে। আমি মামাকে বললাম জামাকাপড় আনতেও যেতে দিচ্ছেনা আমাকে। মামাও রিকোয়েস্ট করলেন। তখন মামাকে বলা হলো এত রাতে নাকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব "ঝুট ঝামেলা" চায় না! তারা বড়জোর বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে করে মামার বাসায় পৌঁছে দিতে পারে আমাকে, রাত বেশি হয়ে গেছে সেজন্য।
ঘেন্নায় বমি পেল আমার। মামাকে বললাম উবার কল করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে আমি যাবনা। এই বলে উঠে গায়ের সমস্ত শক্তি রুমের দরজার উপর প্রয়োগ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। তখন আপাতত আর বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছা আমার মধ্যে ছিলনা। ইচ্ছে ছিল থানার সামনে চলন্ত গাড়ির নিচে ঝাপ দেব। আমাকে এভাবে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখে থানার বাকিরা দৌড়ে গিয়ে আমার পথ আটকালো। আমাকে বাইরে যেতে দেবে না। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, বাইরে যাবার স্বাধীনতাটুকুও নেই আমার? ওরা চুপ করে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, কোনো উত্তর দিল না। আমি দুইহাত জোড় করে বললাম তাহলে আমার ব্যাগে ইয়াবা ঢুকায়ে দিয়ে আমাকে মেরে ফেলেন। আমি বের হবার সময় থানার দরজায় লাথি মেরে বেরিয়েছি, এরজন্যও তো আমাকে মেরে ফেলতে পারেন। এতোটুকু সাহায্য করেন আমাকে। দোহায় আপনাদের। আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না। সুমন ভাইয়া আমার পেছন পেছন দৌড়ে এসেছিল। আমাকে শান্ত করতে ধমক দিল। আমি আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। ওসির রুমের বাইরে মামার সাথে ওসি আর স্যার ম্যাম কি যেন কথা বলছিল, আমি গেট থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম না কিছু। দেরি হচ্ছিল আসতে। পরে জানতে পেরেছিলাম, আমাকে সেই রাতে থানায় কাস্টাডিতে রেখে দিতে চেয়েছিল। ওসি খুব ক্ষেপেছিল আমার ওপর। মামা কোনোরকমে হাতেপায়ে ধরে নিয়ে এসেছিল। আমার জন্য মানুষটাকে আর কোনোদিন অপদস্ত না হওয়া লাগুক। দেশের জন্য যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা মানুষটাকে আর কখনো কারও কাছে ছোট না হওয়া লাগুক।
গাড়ি আসলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। মামা আমাদের নিয়ে গাড়িতে বসলো। একেবারে ফাঁকা রাস্তা, একফোঁটা জ্যাম নেই। গাড়ির জানালায় পানির বিন্দু। আমি অসহায়ের মতন বাইরে তাকিয়ে আছি। নিজেকে মুক্তির জন্য তড়পাতে থাকা বন্দি চড়ুইটার মতন মনে হচ্ছিল। মামার বাসায় আসলাম। মামী, নিশিপু কারোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। আমাকে দেখে মনেহয় একটু স্বস্তি পেল ওরা। আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করলাম আমাকে কেন এখানে নিয়ে আসলেন? হলে কেন যেতে দিলেন না? এতবড় অন্যায় কেন হতে দিলেন। তারপর মামা ঘটনা বললো, কিভাবে হাতেপায়ে ধরে আমাকে ছাড়ায়ে নিয়ে আসছে। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম একেবারে। আর বলার কোনো কথা খুঁজে পেলাম না। ফ্রেশ হতে বাথরুমে চলে গেলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। তারপর গায়ে পানি ঢালতে লাগলাম। আমার ইচ্ছে করছিল সব পাপ ধুয়ে পানির সাথে বের করে দিতে, কিন্ত ও বেচারাও সে রাতে আমার সাথে নেই বুঝতে পেরেছিলাম। শরীরে আর একদম বল নেই। গোসল করে বেরিয়ে আসার পর মামী ভাত দিলো। আমার খাওয়ার মতন শক্তি নেই। তারপর শরবত দিয়ে বললো অন্তত শরবতটা যেন খাই, নাহলে আমি বাঁঁচব না। দুইগ্লাস শরবত খেলাম। তারপর ফ্লোরেই শুয়ে পড়লাম। আর নড়ার শক্তি নেই। বাসা থেকে আব্বু ফোন দিল। মামা ধরায়ে দিল। আমি লজ্জায় কথা বলতে পারলাম না। আব্বু বললো, তুই ঠিক আছিস? মানসিকভাবে স্ট্রং থাক। আমরা সবাই তোর পাশে আছি। নিজের মেয়েকে এমন ভালোভাবে খুব কম বাবাই পড়তে পারে। আমার মধ্যে যে ঝড় যাচ্ছিল, আমার আব্বুটা তা ফিল করতে পারছিল। বুঝতে পারছিলাম আমি। আমি শুধু বললাম, আব্বু, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আব্বু রেস্ট করতে বলে ফোন রেখে দিল। তারপর কি হয়েছে আমি আরকিছু জানিনা।
ঘুম ভাঙলো পরেরদিন দুপুর একটায়। আব্বু চলে এসেছে। আমার সাথে দেখা করে তারপর হলে যাবে। উঠে ফ্রেশ হয়ে দুইজন একসাথে খেলাম। আব্বু কিছুক্ষণ রেস্ট করে সাড়ে তিনটার দিকে বেরিয়ে গেল হলের উদ্দেশ্যে। হলে কথা বলে আব্বু চলে আসলো। আমার রুমমেটদের তখন খুব প্যারা নিতে হয়েছিল আমার জন্য। আব্বু আসলো ব্যাগ নিয়ে। সন্ধ্যা থেকে প্রায় রাত দশটা আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো। আমরা ঘুমোলাম রাত ১২টার দিকে। সকালে আবার তাড়াতাড়ি না উঠতে পারলে বাসায় ফিরতে দেরি হবে। ১৬তারিখ সকালে আমরা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম...
বাসায় এসে সবার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম কি পরিমাণ ক্ষত হয়ে গেছে আমার কারণে তাদের মধ্যে। ফ্রেশ হয়ে আসার পর আম্মু ভাত দিল। খেতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার গলা দিয়ে ভাত ঠিক নামছে না। অবাক হলাম না, '১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবার হয়েছিল মাসখানেকের জন্য এরকম। ডিপ্রেশনের কোন একটা স্টেজে যেন হয় এরকম। ইটিং ডিসঅর্ডার না কি যেন বলে এটাকে। এবার সপ্তাহখানেক ছিল। বাসাটা একেবারে খাঁচা মনে হতে লাগলো আমার। দম বন্ধ হয়ে আসে, বাইরে যেতেও ইচ্ছে করেনা। কিছুটা বলার জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকি, আবার কারোর সাথে কথা বলতেও ইচ্ছা করেনা। আমার ফোন ফেরত দেয়নি ডিবি থেকে। বাসায় বইখাতা কিছুও নিয়ে আসা হয়না৷ টিভি দেখতেও অসহ্য লাগতো। বেডরুমের বালিশে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে আমার দিন কাটতে লাগলো। আমার আব্বুটা যত বড় অন্যায়ই করি না কেন, আমার চোখে পানি দেখলে আমাকে বেশি কিছু বলতে পারতনা আমি বাইরে আসার পর থেকে। সে এসে দেখত আমি শুয়ে শুয়ে কাঁদতেসি। আমি এক কোণে গুটিসুটি মেরে কাঁদতাম, আমার আম্মুটা আরেক পাশে অসহায়ের মতন বসে থাকতো। নিজেকে সন্তান হিসেবে দুনিয়ার সবচাইতে অযোগ্য, নিকৃষ্ট মনে হত আমার। নিজের সাথে সাথে পুরো পরিবারটাকে ডুবিয়েছিলাম আমি। এর মাঝে কোরবানির ঈদ আসলো। আমি তো নিজেকে ১৫ আগস্ট রাতেই কুরবানি দিয়ে এসেছিলাম শাহবাগ থানায়, আমার আবার কিসের ঈদ! গতবছরের কুরবানি ঈদের কোনোকিছুই মনে নেই আমার...
লেখক: ভিপি, শামসুন নাহার হল সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখাটি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমির ফেসবুক থেকে নেয়া।