অনেক প্রাইভেটের চেয়ে ভালো ৭ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় করে সমাধান
- মাছুম বিল্লাহ
- প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০১৯, ০৯:২৯ AM , আপডেট: ০১ আগস্ট ২০১৯, ০৯:৪১ AM
আমরা জানি, ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ ও মিরপুর বাঙলা কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়।
শুরুর দিকে উচ্ছ্বসিত হলেও এক বছর যেতে না যেতেই সংকটের মুখোমুখি পড়তে হয় এ কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের। তখন চতুর্থ শিক্ষাবর্ষ ও চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা নামেন ফল প্রকাশের দাবির আন্দোলনে। একজন শিক্ষার্থী চোখ হারান সেই আন্দোলনে।
সম্প্রতি প্রকাশিত পরীক্ষার ফলাফলে গণহারে ফেলের চিত্র দেখে শিক্ষার্থীরা আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে ১৬ জুলাই রাতে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা।
সর্বশেষ ২০ জুলাই সংকট সমাধানে ঢাবি কর্তৃপক্ষকে সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা তো নিজে থেকে ঢাবির অধিভুক্ত হতে চাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপাচার্যের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে সাত কলেজ ঢাবির অধিভুক্ত হয়।
তারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই ভালো ছিলেন। সেশনজট, সময়মতো পরীক্ষা না হওয়া, রেজাল্ট না দেয়া, গণহারে ফেল করানোসহ বিভিন্ন কারণে তারা এখন ক্ষুব্ধ। এ সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, তাদের খাতা ঠিকমতো মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। অথচ ঢাবির শিক্ষকরা বলছেন, খাতা ৯০ শতাংশই দেখেছেন কলেজের শিক্ষকরা, বাকি দশ শতাংশ দেখেছেন তারা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের বন্ধুরা যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের কলেজে ছিল তারা এখন বের হয়ে যাচ্ছে অথচ তাদের কোনো অগ্রগতি নেই।
তারা আরও বলছেন, একই প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ক্লাস, পরীক্ষা সম্পন্ন করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ছে। আর তার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
২১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সামাদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির প্রতি প্রশাসনের সমর্থন রয়েছে। তাদের এ দাবিগুলো পূরণে সাধ্যমতো চেষ্টা করব। তবে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করার এখতিয়ার নেই, এটি সরকারের সিদ্ধান্ত।’
এ বিষয়ে সাত কলেজের সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেন, ‘সাত কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম আলাদাভাবে পরিচালনা করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না। শিক্ষার্থীদের শিক্ষায়ও কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। ফল প্রকাশে আমরা এখনও ম্যানুয়েল পদ্ধতি অনুসরণ করছি। তবে শিগগিরই এর ডিজটালাইজেশন করা হবে। তখন দ্রুত ফল প্রকাশ করতে পারব।’
এমনিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবল, অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, উপরন্তু বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর এ সাত কলেজের তাদরকির পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রচুর সময় ব্যয় হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কিছুদিন আগে টাইমস হায়ার এডুকেশন নামের একটি সংস্থা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র্যাংকিং প্রকাশ করেছে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকা, এমনকি এশিয়ার সেরা চারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নাম না থাকার কারণে চারদিকে সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব তথ্যাবলী ওয়েবসাইটে ঠিকমতো আপডেট করা না থাকায় বিশ্বব্যাংকিংয়ে স্থান হয়নি। আসলে বিষয়টি তা নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের কাছে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’; কিন্তু এর বর্তমান পরিস্থিতি কী? শিক্ষার্থীরা যখন সামান্য স্বার্থ নিয়ে মারামারি-খুনাখুনিতে ব্যস্ত হয়ে সরগরম রাখে এ ক্যাম্পাস, সেটি তো আন্তর্জাতিক চোখ এড়িয়ে যায় না।
বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় যখন সঠিক গবেষণা আর উৎকৃষ্ট শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করা নিয়ে ব্যস্ত, আমরা তখন শিক্ষার্থীদের কোন্দল মেটাতে ব্যস্ত। এ পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে আশা করতে পারি, বিশ্বর্যাংকিংয়ে ঢাবিকে থাকতেই হবে।
তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। যুক্ত করেছে নতুন নতুন বিষয়। ক্রমান্বয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা বৃদ্ধি পাওযায় নতুন কিছু অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। তবে সেই হারে আবাসিক সুবিধা ও লাইব্রেরি সুবিধা বাড়ছে না। সরকারের কাছ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার দ্বিতীয় ক্যাম্পাস করার জন্য পূর্বাচলে কিছু জমি পেয়েছে, সেটুকু যথেষ্ট নয়। এগুলো আশা জাগানিয়া পদক্ষেপ।
বাহলুল মজনুন চুন্নু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য, বলেছেন, ‘একটা চিন্তার বিষয় হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু বিভাগ আছে যেগুলোর ঐতিহাসিক ও গবেষণাগত মূল্য অনেক হলেও এবং বর্তমান যুগে তার পেশাগত মূল্য খুব একটা না থাকলেও ক্রমাগত সেসব বিভাগেও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এসব বিভাগ থেকে ছাত্রছাত্রীরা পাস করে দীর্ঘকাল বেকার থাকে অথবা ছোটখাটো চাকরি করে যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জার। অনেক শিক্ষার্থীই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পেরেছি এ স্বস্তিটুকু পাওয়ার জন্যই এসব বিভাগে ভর্তি হয়। এগুলোও বাস্তব কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে যদি সাত কলেছে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থীর একাডেমিক ও অন্যান্য কার্যাবলী চালিয়ে নিতে হয়, তা নিতান্তই নেয়ার জন্য নেয়া। তাছাড়া এ সাত কলেজের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে সময় ব্যয় হচ্ছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এতে সেশনজট সমস্যা সৃষ্টিরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এটিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ কর্তৃক ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনাও ঘটে। এরপর নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে ক্যাম্পাসে। সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ দেখা দেয় ২৩ জানুয়ারি। আন্দোলনকারীরা গেট ভাংচুর করে, উপাচার্যকে আটকে রাখে। আসলে সমাধানের পথ তো এগুলো নয়।
তবে, এটিও ঠিক শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তায় নামেন তখনই দেখা যায় কর্তৃপক্ষকে একটু নড়েচড়ে বসতে। তাদের খেয়াল রাখতে হবে, এ বিষয়টি কিন্তু বহু বিষয়কে প্রভাবিত করছে। তাই সমাধান দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।
ঠিকমতো পরীক্ষা না হওয়ায় সেশনজট ধীরে ধীরে বাড়ছে যা অধিভুক্তির আগে ছিল না। ক্লাসজট আর পরীক্ষাজট থেকে শেষ পর্যন্ত সেশনজট তৈরি হচ্ছে। অধিভুক্তির আগে একজন শিক্ষককে প্রতি ক্লাসের ৭০-৮০ শিক্ষার্থীর খাতা দেখতে হতো। এখন সাত কলেজের মিলে ৩০০-৪০০ খাতা মূল্যায়ন করতে হচ্ছে। সঠিক মূল্যায়ন নিয়ে তাই ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। তাছাড়া ক্লাসে সময় কম দেয়ায় ঢাবির শিক্ষার্থীরা সার্বিকভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের আরেকটি পয়েন্ট হচ্ছে, তারা তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ঢাবিতে ভর্তি হয়েছেন, ওই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এখন এ পার্থক্যটি থাকছে না।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাবি এমনিতেই বিশ্ব র্যাংকিংয়ে পেছনের দিকে, এর ওপর ক্রমাগত মান কমতে থাকলে আগামীতে আরও সংকট সৃষ্টি হবে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দাবি করেন।
অধিভুক্তি বাতিল দাবির প্রধান কারণ ঢাবির শিক্ষার মান কমে যাওয়া। শিক্ষকরা সাত কলেজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এতে সার্বিক শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘শিক্ষক সাত কলেজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার প্রভাব পড়ছে আমাদের ক্লাস ও পরীক্ষায়।’ এছাড়াও শিক্ষার্থীরা বলেন, তাদের ক্লাস ঠিকমতো হচ্ছে না, কারণ শিক্ষকরা অনেকেই সাত কলেজের পরীক্ষা কমিটির সদস্য। তারা ওইসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত। অনেক শিক্ষক সাত কলেজের ভাইভা নিতে যান। তাদের পরীক্ষার খাতা দেখেন।
এসব কারণে ক্লাস কম হওয়ায় সিলেবাস শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে। এ কারণে পরীক্ষাও পেছাতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা আর একটি বিষয় উত্থাপন করেছেন সেটিও রীতিমতো উদ্বেগের।
তারা বলছেন, শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাস ঠিকমতো নিচ্ছেন না, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে মাসের পর মাস সময় নিচ্ছেন অথচ বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত কিছু সান্ধ্যকালীন কোর্স করান, যেগুলোর ক্লাস ঠিকমতো হওয়া ছাড়াও পরীক্ষার খাতাও সঠিক সময়ে দেখা হচ্ছে, ফল প্রকাশ করা হচ্ছে।
তারা সাত কলেজের সঙ্গে এগুলোও বাতিল করার দাবি করতে চাচ্ছেন। তারা মনে করেন, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পড়াশোনার পরিবেশ অনেকটাই ফিরে আসবে। বামজোটের পক্ষ থেকে আর একটি দাবি এসেছে, অধিভুক্ত সাত কলেজের মধ্যে কয়েকটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করে সমস্যার সমাধান করা যায়।
এটিও খারাপ যুক্তি নয়, কারণ স্বল্প পরিসরে কিংবা শুধু বিল্ডিংয়ে যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার চেয়ে ঢের ভালো পরিবেশ রয়েছে এসব কলেজে। সহজেই দু-একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে বর্তমান সমস্যার সমাধান করা যায়। এসব কলেজে রয়েছে সুন্দর ক্যাম্পাস, ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সুবিধা। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।
মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক
masumbillah65@gmail.com
সংগৃহীত