বড় ভাইরাই এখন সালাম দেয়...
- ফরহাদ কাদের
- প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০১৯, ১২:১৯ AM , আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৯, ০৯:২৩ AM
ইকবাল হোসেন (ছদ্মনাম)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের গণরুমের শিক্ষার্থী। পড়েন কলা অনুষদভূক্ত বাংলা বিভাগে। ডাকসু পরিস্থিতি নিয়ে সংক্ষেপে জানতে চাইলে শুরুতেই মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘ক্যাম্পাসে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। রাজনৈতিক চাপ, মিছিল-গেস্টরুম নেই। আগে বড় ভাইদের সালাম দিতে হত; এখন তারাই আমাদের দেয়।’
ইকবাল জানালেন, আগে গেস্টরুম-মিছিলে কে গেছে, কে যায়নি- সেই হিসাব হত। ডাকসু নির্বাচনের ডামাডোল শুরুর পর এখন গেস্টরুম নেই, মিছিল-মিটিংও উধাও। উল্টো বলতে হয়, বড় ভাইয়েরা আমাদের রুমে নিয়মিত আসছে। লোভনীয় সব প্রস্তাব দিচ্ছেন। এমনও প্রস্তাব এসেছে- জিততে পারলে গণরুমে থাকতে হবে না। দ্রুত সিট হয়ে যাবে; নতুন হল নির্মাণ করা হবে। ক্যান্টিনে খাবারের দাম কমানো হবে, আরো কত কী!
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্র আন্দোলন, অধিকার আদায় কিংবা অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো- সবই হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু ডাকসুর বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা বলার প্ল্যাটফর্ম ওইভাবে তৈরি হয়নি গত ৯৮ বছরেও। তবে হারিয়ে যাওয়া সেই ডাকসুই ২৮ বছর পর পুনরুদ্ধার হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ডাকসু নিবার্চনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক ছাত্র নেতারা নানাভাবে সাধারণ ছাত্রদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। ক’দিন আগেও যে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গেস্টরুমে ডেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোপের ওপর রাখার অভিযোগ ছিল, তারাই এখন ছুটে যাচ্ছেন ছাত্রদের রুমে রুমে। সবমিলিয়ে বলা যায়, প্রায় তিন দশক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কাযক্রম শুরুর পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব বেড়েছে।
ক্যাম্পাস পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত ২৮ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাজনীতিতে ‘বিশেষ একটি ধারা’ চলে আসছে। যেখানে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো কোনো স্তরেই সাধারণ ছাত্রদের কাছে দায়বদ্ধ নয়। এতে করে রাজনীতির সবচেয়ে নোংরা সব সংস্কৃতি দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠে শিকড় গেড়েছে। পর্যবেক্ষকদের অভিমত, বিগত সময়গুলোতে যখন যে দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছাত্র সংগঠনই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানি ও হেনস্থা করেছে। সেই ছাত্রলীগই হোক কিংবা ছাত্রদল-শিবির ও অন্যসব সংগঠন! সংগঠনের ব্যানারে গেস্টরুম-প্রোগ্রামের নামেও চালিয়েছে বিভিন্ন ধরনের উৎপীড়ন। দলীয় প্রোগ্রামে না যাওয়ার কারণে গেস্টরুমে মারধর, অপমান-অপদস্ত করাও ছিল অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনা। কথায় কথায় হল থেকে বের করে দেয়া তো কোনো ব্যাপারই নয়!
মূলত এমন পরিস্থিতির মধ্যে ডাকসু নিবার্চনের ঘোষণা আসায় সেই অবহেলিত সাধারণ ছাত্ররাই এখন তুরুপের তাস। তাদের ভোটেই জিততে হচ্ছে প্রতাপশালী সব ছাত্র নেতাদের। আর এ কারণেই বিগত তিন দশকে সবচেয়ে অবহেলিত গণরুমের ছাত্ররাই এখন ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়ানো নেতাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যমতে, ডাকসু নিবার্চনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই ছাত্র নেতারা নানাভাবে সাধারণ ছাত্রদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের নেতারা এখন গেস্টরুমে ডেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোপের উপর রাখার বদলে নিজেরাই ছুটে যাচ্ছেন ছাত্রদের রুমে রুমে। ব্যক্তিগতভাবে কার কী সমস্যা তা জানতে চাচ্ছেন। নিজে নিবার্চনে প্রার্থীর হয়েছে জানিয়ে নিবাির্চত হলে সব সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন।
অনুসন্ধানের তথ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি রাজনীতি হয় সিট বাণিজ্য নিয়ে। সিট স্বল্পতা যে ক্ষমতাসীনদের প্রধান অস্ত্র, সেই সিট সঙ্কট নিয়েও দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয়ভাবে যেসব প্রতিশ্রুতি সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন ক্যাম্পাসে টাঙিয়েছেন সেখানে পযার্প্ত হল নির্মাণের দাবি জানিয়েছে ছাত্র সংগঠনটি। অথচ বিগত তিন দশক ধরেই এই হল সঙ্কটকে জিম্মি করে ঘুরছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রদের ব্যবহার করে রাজনীতির চাবিকাঠি। বিগত ১০ বছরে এ বিষয়ে ছাত্রলীগকে একটা টু শব্দ করতে শোনা না গেলেও বিষয়টিতে এখন তারা ভীষণ সরব।
আবার বিরোধী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ক্যাম্পাসে না থাকলেও তারাই এখন নানাভাবে যোগাযোগ করছেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। দিচ্ছেন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি। বিশেষ করে হল সঙ্কটের বিষয়ে ছাত্রলীগের মতো তারাও দিচ্ছেন একগাদা বুলি। অথচ বিগত প্রায় তিন দশকের পুরো সময়জুড়েই এ ছাত্র সংগঠন দুটি ক্যাম্পাস শাসন করেছে। সে সময় সিট সঙ্কট নিয়ে চুপ থাকা সংগঠন দুটির হঠাৎ অলৌকিক বাক বদলে অনেকেই অবাক হলেও ছাত্র সংসদ নিবার্চন হলে তাদের এ সিট বাণিজ্যের সাম্রাজ্য যে আর রক্ষা করা যাবে না সে বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে একটি ধারণা পেয়েছেন। আর এ কারণে যেকোনো মূল্যে ডাকসু নিবার্চন চাইছেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাও।
বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো সংখ্যায় কম হলেও তারা নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। পিছিয়ে নেই কোটা সংস্কার আন্দোলন করে দেশজুড়ে সাড়া ফেলা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদও। প্রত্যেকেই স্ব স্ব জায়গা থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করছেন।
রোকেয়া হলের তমালিকা তাহা নামে এক শিক্ষার্থী বলছেন, আমি তিন বছর ধরে হলে আছি। এ সময়ে আমাদের রুমে কোনো পলিটিক্যাল আপু কখনো খোঁজ নিতে এসেছেন; এটা মনে করতে পারি না। কিন্তু বিগত এক সপ্তাহে একের পর এক বড় আপুরা রুমে এসেছেন। বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইছেন। কোনো সমস্যা আছে কি-না, থাকলে যেন আপুকে ফোন দিয়ে জানাই। আরও কত কি! এ থেকে বুঝতে পারছি ডাকসু নিবার্চনের ঘোষণা আমাদের কদর কতটা বাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শ্রেণির ছাত্রদের সুসম্পর্ক রয়েছে। শুধু ডাকসু নির্বাচনের কারনে নয়। আমরা সবসময়ই সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব।’
এর আগে ডাকসুর এজিএস প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংগঠন। অতীতে তারা শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশেই ছিল না, তাদের অধিকার নিয়েও কাজ করেছে। ডাকসুতে বিজয়ী হলে ছাত্রলীগ হল সঙ্কট, লাইব্রেরিতে সিট সঙ্কট, শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত মাল্টিমিডিয়াসহ শিক্ষা উপকরণের নানা দিক নিয়ে কাজা করার কথা জানান।
আরও পড়ুন: অনাবাসিক ভোটারদের ভয় কাটছে না
আরেক এজিএস প্রার্থী ও বাংলাদেশ সাধারণ শিক্ষার্থীর অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের জন্মই হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে। স্বাধীনতার পর কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীর কোনো দাবি পূরণে রাস্তায় নেমেছে বা আদায় করে দেখিয়েছে এমন নজির নেই। তারা সবসময় তাদের দলের নীতি আদর্শ সাধারণ ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিতেই তৎপর ছিল।’ ডাকসুতে জিতে অধিকার নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভেতরে ঢুকে কাজ করার কথা জানান তিনি।