অনাবাসিক ভোটারদের ভয় কাটছে না

ডাকসু ভবন
ডাকসু ভবন  © ফাইল ফটো

রাসেল আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তৃতীয় বর্ষে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। থাকেন রাজধানীর শেওড়াপাড়ায়। পরিবারের সাথে। সম্প্রতি ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবের আমেজ বিরাজ করলেও তাতে খুব একটা নজর নেই রাসেলের। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে রাসেল জানালেন, ‘অনেক দিন পর ডাকসু নির্বাচন। হয়তো এটাই আমার প্রথম এবং শেষ। তাই ভোট দেয়ার ইচ্ছা আছে। তবে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে যেহেতু নষ্ট নজির আছে; তাই কিছুটা ভয় পাচ্ছি।’ রাসেল জানান, ভোটকেন্দ্র ক্যাম্পাসে হলে একটু বেশি সাহস পেতাম। তারপরও দেখা যাক- কী করি।

এমন শঙ্কা শুধু রাসেলের নয়, অনেকের মধ্যেই কাজ করছে। ডাকসুর ভোটার কিন্তু হলে থাকেন না- এমন অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ‘দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’র এই প্রতিনিধির কথা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই বলছেন, হলগুলোতে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য বিরাজ করছে। সে হিসেবে ভোটকেন্দ্রে ‘কিছু একটা ঘটে যাওয়া’ অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তাছাড়া ভোটের রাজনীতিতে আস্থা কমে গেছে বলেও জানান এই ছাত্ররা।

শিক্ষার্থীদের দাবি, পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন ও তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের বিষয়টি জরুরি। যেটা প্রশাসনকে আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে শিক্ষার্থীদের ভয় কাটবে না বলেও জানান ওই ছাত্ররা।

পড়ুন: যতক্ষণ ভোটার থাকবে, ততক্ষণই ভোটগ্রহণ: রিটার্নিং কর্মকর্তা

তথ্যমতে, দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ভোট হতে বাকি মাত্র ২দিন। স্বভাবতই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জমজমাট প্রচারণায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন সরগরম। তবে নির্বাচন নিয়ে উচ্ছ্বাস যেমন রয়েছে, তেমনি উদ্বেগ-উৎকন্ঠাও রয়েছে ঢের। আছে পরস্পরবিরোধী নানা অভিযোগ। এক্ষেত্রে একদিকে ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হবে বলে আশা প্রকাশ করলেও স্বতন্ত্র ও প্যানেল মনোনীত প্রার্থীরা আছেন ‘ভোট ডাকাতি’ ও ‘কারচুপি’র শঙ্কায়। 

ডাকসু ও ও হল সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪২ হাজার ৯২৩টি। আগামী ১১ মার্চ সকাল ৮টা হতে থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের একটানা ভোট গ্রহণ হবে। ১৮টি হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। অন্যদিকে ডাকসুর ২৫টি পদে ১২টি প্যানেল থেকে ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ২২৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ভিপি (সহ-সভাপতি) প্রার্থী ২১ জন এবং জিএস (সাধারণ সম্পাদক) প্রার্থী ১৪ জন। এর সঙ্গে ১৮টি হল সংসদে ১৩টি পদে মোট ২৩৪টি পদে প্রার্থী ৫০৯ জন।

ডাকসু ভবন

এদিকে ১৮টি হলের মধ্যে মেয়েদের ৫টি ছাড়া বাকিগুলোতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকাতে ভোটকেন্দ্র হলের পরিবর্তে একাডেমিক ভবনে ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছিলেন অনেকেই। হলেই ভোট কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় তারা অভিযোগ করেন ‘ছাত্রলীগকে সুবিধা’ দিতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে করে ভোট কেন্দ্রে অনিয়ম হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। যদিও শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের সিদ্ধান্তই বহাল থাকে।

গত রোববার প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রার্থীরা। এতে দখলদারিত্বের রাজনীতি তিরোহিত হয়ে অন্তত ক্যাম্পাসে সহাবস্থানের সংস্কৃতি ফিরে এসেছে বলে মনে করছেন অনেকেই। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বামসহ বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা ভোটের প্রচারণা চালাচ্ছেন নির্বিঘ্নে। ক্যাম্পাসে সাধারণ ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে লিফলেট পৌঁছে দেয়া, গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ব্যানার টাঙানো হয়েছে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে। হাকিম চত্বর, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী, শ্যাডো, টিএসসির মতো আড্ডা দেয়ার জায়গাগুলোতেও বইছে ভোটের আমেজ। একই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতেও। সেখানে স্ব স্ব হলের প্রার্থীরা হলের গেইট, ক্যান্টিন এবং টিভিরুমে নিজেদের ব্যানার-পোস্টার টাঙিয়েছেন। রুমে রুমে গিয়ে বিতরণ করছেন লিফলেট।

নির্বাচনের সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদল প্যানেল থেকে ডাকসুর জিএস প্রার্থী মো. আনিসুর রহমান খন্দকার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা আগে থেকেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের লক্ষ্যে সাত দফা দাবি জানিয়েছিলাম। এর মধ্যে বাইরের শিক্ষার্থীদের ভোট দেয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে একাডেমিক ভবনগুলোতে ভোটকেন্দ্র করার দাবি জানায়। কিন্তু প্রশাসন আমাদের দাবি মানেনি। আমরা আমাদের দাবির বিষয়ে এখনো অবিচল। তবে নির্বাচনের দিন যদি কোন ধরণের অনিয়মের অভিযোগ পাই; তবে প্রতিরোধ করব। ছাত্রদল অনিয়মের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।

নির্বাচনে অনিয়ম হতে পারে বলেও ধারণা করছেন ডাকসুর স্বতন্ত্র জিএসপ্রার্থী এম আর আসিফুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা প্রচারণার সময় একটি বিষয় খেয়াল করেছি সেটি হলো- হলের ভোটার এবং হলের বাইরের ভোটারদের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। হলের যারা ভোটার রয়েছে; তাদের মধ্যে অনেকেই তাদের যোগ্য প্রার্থীদের বেছে নিতে চায়। কিন্তু হলের বাইরের ভোটাররা হলে এসে কীভাবে ভোট দেবেন তা অধিকাংশ জানে না। অনেকের হলের কার্ড নেই। আবার অনেকের মেয়াদ শেষ। তাছাড়া হলের পরিবেশ সম্পর্কে না জানায় তারা ভোট দিতে আসতে শঙ্কায় থাকবেন। আর কোন ধরণের অনিয়ম হলে তখনই পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেব।

অনিয়ম হলে আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ও। পরিষদের যুগ্ম-আহবায়ক ও ডাকসুর জিএস প্রার্থী মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন বলেন, আমরা হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র করার দাবি জানিয়েছিলাম। আমরা দাবির পক্ষে স্মারকলিপিও দিয়েছি। কিন্তু প্রশাসন ছাত্রলীগকে সুবিধা দিতেই হলে ভোট কেন্দ্র করে। আমরা নির্বাচনের দিন কোন ধরণের অনিয়ম হতে দেব না। অনিয়ম হলে সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলব।

পড়ুন: ছাত্রদল প্রার্থীর ব্যানার খুলে ফেলছে ছাত্রলীগ

স্বতন্ত্র জিএস প্রার্থী ও বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজীর। তিনি বলেন, আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচনে কোন ধরণের অনিয়মের খবর শুনলে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব। কিন্তু এতে কোন কাজ না হলে ভোট বর্জনের ঘোষণাও দিতে পারি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো আখতারুজ্জামান বলেন, শঙ্কার কারণ নেই। ডাকসু নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে আমরা বদ্ধপরিকর। ভোটের দিন পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকবে বলেও জানান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ