ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সিট রাজনীতি: প্রথম বর্ষেই দমে যাচ্ছে স্বপ্ন সাহস

ঢাবি আবাসন সংকট
ঢাবি আবাসন সংকট  © টিডিসি ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে দেশ সেরা মেধাবীরা ভর্তি হন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদের স্বপ্ন থাকে আকাশ ছোঁয়া, আশা থাকে বুক ভরা। কিন্তু স্বাপ্নিক সে জীবন যখন গণরুম, গেস্টরুম আর ‘সিট সংকট’র বঞ্চনায় শুরু হয়; দমে যাওয়া হতাশা তো তখন আসবেই। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালটির ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে বৈধ সিট দেয়া হয় না। আর এটাই নবীন শিক্ষার্থীদের ছাত্রনেতাদের হাতে নির্যাতন-নীপিড়নসহ নাম না জানান অগণিত সমস্যার সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রভোস্ট কমিটি’র এক বৈঠকে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে সিটি না দেয়ার বিষয়ে এক সিদ্ধান্ত নেয়। যা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে অনুমোদন হয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে অনাবাসিক কার্ড পায়, আর ২য় ও ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের দেয়া হয় দ্বৈতাবাসিক কার্ড। যদিও নতুন হল নির্মাণ হওয়ায় এবং ছাত্রী হলগুলোতে বিশেষ বিবেচনায় প্রথম বর্ষেও আবাসিক কার্ড পাওয়ার নজির রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবকটি হলে অবস্থানরত অন্তত দু’জন করে প্রথম বর্ষে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। যদিও এদের অধিকাংশই নাম প্রকাশ করা শর্তে কথা বলতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, বৈধভাবে সিট না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করে হলে উঠতে হয়; যেখানে হল কর্তৃপক্ষের সাথে কোনো সম্পর্কই থাকে না। শুধু তাই নয়, কর্তৃপক্ষ জানেও না- কে, কখন, কীভাবে হলে উঠছে। জিয়াউর রহমান হলের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী জানান, অন্তত হলে উঠতে প্রশাসনের সাহায্য নিয়েছেন; এমন কাউকে খুঁজে পায়নি সে। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে আবাসিক শিক্ষকদেরও মাথাব্যাথা নেই। কারণ, শিক্ষার্থীদের দেখ-ভালের যে দায়িত্ব তাদের পালন করার কথা; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটি কার্যকর হয় না।

ঢাবি গণরুমের চিত্র: ফাইল ছবি

প্রায় একই বক্তব্য সূর্যসেন হলের আরেক শিক্ষার্থীর। তিনি বলেন, প্রথম বর্ষে সিটের কথা চিন্তা করা যায় না। রাজনীতিতে ভালো করতে দ্বিতীয় বর্ষের শুরুর দিকেই সম্ভাবনা থাকে। শামসুন্নাহার হলের আরবী বিভাগের এক ছাত্রী বলেন, প্রশাসনের মাধ্যমে হলে উঠতে দীর্ঘদিন লেগে যায়। তাই ছাত্রলীগের মাধ্যমে উঠেছি। কারণ, ঢাকায় প্রথম আসা; থাকাটাই তো জরুরি।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের বাস্তব করুণ চিত্র দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ হলে চারজনের একটি রুমে (গণরুম) সারিবদ্ধভাবে ঘুমাতে হয় অন্তত ১৫ থেকে ২০ জনকে। প্রথম বর্ষের জন্য তৈরি এসব পড়ার জন্য টেবিল তো দূরের কথা, ঘুমানোর জায়গাটুকুও হয় না অনেক সময়। বাধ্য হয়েই থাকতে হয় হলের বারান্দা, টিভিরুম বা মসজিদে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিন্নভাবে অনুসন্ধান করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট ব্যাপারটির অস্তিত্ব নেই। রবং এখানে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। তাদের ভাষ্য, গত ১০ বছরে ততোধিক হল নির্মাণ ও সম্প্রসারণ হলেও মাস্টার্স উত্তীর্ণ অছাত্র, বহিরাগত ও অবৈধদের আনাগোনা রয়েই গেছে প্রত্যেকটি হলে। আর এটিই নবীন শিক্ষার্থীদের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু যে থাকার জায়গা সময় তা নয়; রীতিমত নির্যাতনের শিকারও হতে হয় শিক্ষার্থীদের। কথা বলে জানা যায়,  গেস্টরুমে আচরণের নাম করে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আইন-কানুন শেখানো হয় হলগুলোতে। যা প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়া সকল ছাত্রের জন্যই বাধ্যতামূলক। সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই দেড় থেকে দুই ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে চলে এই গেস্টরুম। নিয়মের ভিন্নতা হলে ছাত্র নির্যাতন, মারধর ও এমনকি ঢালাওভাবে হল থেকে বের করে দেয়ার  নজিরও রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল

জানতে চাইলে স্যার এ এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ছেলেদের হলগুলোতে দীর্ঘদিন যাবৎ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে; যা ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে গুছিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা হলে ৬ মাস পর পর সিট বরাদ্দের জন্য আবেদন আহ্বান করি। আবেদনের প্রেক্ষিতে সিনিয়রিটির মাধ্যমে সিট বরাদ্দ হয়ে থাকে। এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া অধিকাংশ ছাত্র নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। যাদের পক্ষে রাজধানীতে মেস বা বাসা ভাড়া করে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। মূলত সে কারণেই পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে যে কোনো মূল্যে হলে উঠতে হয় তাকে।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হতে একজন শিক্ষার্থীকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়। এতসব সংগ্রামের পর ক্যাম্পাসে আসা নবীনদের পাশে পুরনো শিক্ষার্থী তথা গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার সহমর্মী হয়ে পাশে দাঁড়াবে; সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এর উল্টোটা হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষাজীবন শুরুর প্রথম ধাপেই হোঁচট খেতে হচ্ছে তাদের। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীনদের দাপট আর বর্বরতার নিষ্ঠুর আঘাতে দিন দিন কোণঠাসাও হয়ে পড়ছে অনেকে। হাসিমাখা মুখগুলো হয়ে পড়ছে মলিন, জীর্ণ।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. অসীম সরকার বলেন, হলে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে সিট বণ্টন করে থাকি। ৪র্থ বর্ষ থেকে সিঙ্গেল সিট দেয়ার চেষ্টা করি। যদিও জগন্নাথ হলে ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীরাও উঠছে। তারা হলে উঠতে পারবে না এ ধরণের কোন সিদ্ধান্ত বা আইন আছে কি-না আমার জানা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ছবি

 

প্রায় একই কথা জানান আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দীন খান। তিনি বলেন, প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের সিট দেয়া হবে না এ ধরণের কোন নীতিমালা থাকার কথা নয়। আমি ২০০৯ সালে যখন হল প্রভোস্ট এর দায়িত্ব পালন করি তখন প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য কয়েকটি রুম দেই। তবে হলে শিক্ষার্থীর তুলনায় সিট সংখ্যা কম থাকায় এটা সম্ভব হয় না।


সর্বশেষ সংবাদ