ডাকসু নির্বাচন

হলেই ভোটকেন্দ্র চায় ছাত্রলীগ, প্রশাসনও রাজি!

আদালতের নির্দেশে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। এরইমধ্যে অবাধ নির্বাচন সম্পন্নে ছয় সদস্যবিশিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে গঠনতন্ত্র সংশোধনে গঠিত কমিটি। গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত হলে ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং তফসিল ঘোষণা করার কথা। যদিও সবকিছুকে ছাপিয়ে ভোটকেন্দ্র ভেন্যু নির্ধারণ ইস্যুতে নানামুখী সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনসহ ক্রিয়াশীল অন্যান্য সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে ভোটকেন্দ্র দাবি করলেও হলেই চাইছেন ছাত্রলীগ নেতারা। যাতে প্রাথমিক সম্মতি পাওয়া গেছে প্রশাসন সংশ্লিষ্ট কর্তাদের বক্তব্য থেকে।

সূত্র বলছে, ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা বৈঠকে নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র আবাসিক হলের পরিবর্তে একাডেমিক ভবনে দেয়ার প্রথম প্রস্তাব উত্থাপন করে ছাত্র ইউনিয়ন। অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকেও এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানানো হয়। যদিও আপত্তি জানায় ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে সংগঠনগুলোর লিখিত প্রস্তাবনায় ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য সব ছাত্র সংগঠন হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানায়।

ডাকসুর বর্তমান গঠনতন্ত্রের ৮ (ই) ধারা মোতাবেক আবাসিক হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সব আবাসিক হলে একটি করে ভোটকেন্দ্র থাকবে এবং হলের সংশ্লিষ্ট সদস্যরা ওই ভোটকেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।

তবে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর ভাষ্য, ‘দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় আবাসিক হলগুলো ছাত্রলীগের একক আধিপত্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে হলে কেন্দ্র স্থাপন করলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি তাদের।

ছাত্রসংগঠনগুলোর তথ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক হলে থাকেন। শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ আবাসিক হলের বাইরে মেস বা বাসা ভাড়া করে থাকেন। আবার সরকারের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বাইরে ভিন্ন মতাদর্শী শিক্ষার্থীদের হলে থাকার সুযোগ নেই। এমনকি বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসে আড্ডা দেয়ার অভিযোগেও বিরোধীদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে হলে কেন্দ্র স্থাপন করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ উল্লাহ। শনিবার তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘হলে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য বিস্তার করছে। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে একাডেমিক ভবনে কেন্দ্র স্থাপন করাই যুক্তিসংগত।

তার ভাষ্য, ‘আমরা গঠনতন্ত্রে একটা সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছি। আর তা হলো, ভোট কেন্দ্রগুলো হলে হলে না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবনে করা৷ হলে যে একটা চাপ থাকে, একাডেমিক ভবনে করলে সেই চাপ থাকবে না। সবাই নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন।’

আর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার মনে করেন, আমাদের নেতাকর্মীরা হলগুলোতে অবস্থান করতে পারছেন না। তারা ক্যাম্পাসেও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা বা ক্লাস করতে পারেন না। তাই ডাকসু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো ক্যাম্পাসে সহাবস্থান৷ এই সহাস্থান নিশ্চিত করা না গেলে ডাকসু নির্বাচন অর্থবহ হবে না। তার বক্তব্য, গত ১০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ হলগুলোতে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য তৈরি করেছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে ডাকসুর ভোটকেন্দ্র সেখানে হলে সাধারণ শিক্ষাথীর্রা ভোট দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না। এটি গ্রহণযোগ্য নিবার্চনও হতে পারে না।

তবে ভিন্নমত দিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতারা। হলের ভেতরে কেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে মত দিয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ডাকসুর গঠনতন্ত্রে হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে হলের বাইরে কেন্দ্র স্থাপনের মত এ ধরণের পলায়নপর কথা হাস্যকর ও অবাস্তব।’

ভোটকেন্দ্র হলেই করার ইঙ্গিত পাওয়া প্রশাসন সংশ্লিষ্ট অনেকের বক্তব্যেও। গঠনতন্ত্র সংশোধন, আচরণ প্রণয়ন ও উপদেষ্টা কমিটিতে থাকা সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘হলের বাইরে কেন্দ্র স্থাপন করতে হলে গঠনতন্ত্রে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। সীমিত সময়ের মধ্যে এ পরিবর্তন করা কতটা যুক্তিসঙ্গত হবে; তা নিয়ে ভাবার বিষয় আছে। তবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে আমরা আমরা আমাদের প্রস্তাবনা উপাচার্যের কাছে জমা দেব। তিনিই সিদ্ধান্ত দেবেন।’

এর আগে হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন গঠনতন্ত্র সংশোধন ও পরিমার্জনে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মিজানুর রহমান। গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র করার বিষয়টি অনেকেই বলেছেন, আমি তাঁদের বলি, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কি কলকাতায় করা সম্ভব?’

এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে কাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের সভা ডেকেছে কর্তৃপক্ষ। সভায় পরিবেশ পরিষদে তালিকাভুক্ত ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ডাকসু ও হল সংসদের গঠনতন্ত্র সংশোধনী এবং নির্বাচনী আচরণবিধি সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার লক্ষ্যে এ সভার আয়োজন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে উপাচার্য কার্যালয়সংলগ্ন অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুমে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ভোটকেন্দ্রের ভ্যানু নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

সভার বিষয়ে ইতোমধ্যেই ক্রিয়াশীল সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের ফোনে অবহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী। আমন্ত্রণপত্র হাতে পেয়েছে ছাত্রলীগ। এখনো আমন্ত্রণপত্র হাতে না পেলেও সভার বিষয়ে তাঁদের অবহিত করা হয়েছে বলে অন্য সংগঠনগুলোর নেতারা জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর স্বাক্ষরিত আমন্ত্রণপত্রে বলা হয়েছে, ‘সার্বিক বিষয় বিবেচনায় শুধু ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকবৃন্দ সভায় যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত।’

প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদের সর্বশেষ সভা হয় গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর। সভা শেষে ডাকসু নির্বাচন এ বছরের মার্চে হতে পারে বলে আভাস দিয়েছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।


সর্বশেষ সংবাদ