বছরজুড়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যায় ভারাক্রান্ত শিক্ষাঙ্গন
করোনার কারণে দেড় বছরের বেশি বন্ধ ছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঘরে থেকে হাঁপিয়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মুক্তি আসে গত সেপ্টেম্বর মাসে। এরপর থেকে ঘরবন্দি শিক্ষার্থীদের মুক্তি মিললেও হতাশার গহীন বালুচড়ে আছড়ে পরে তাদের অনেক সহপাঠী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে করেছেন মুক্তির সন্ধান।
বিদায়ী এই বছরজুড়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ২৫০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ফলে এ বছর আরও দীর্ঘ হয়েছে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর মিছিল। আত্নহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল পড়ুয়া থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা পড়ুয়া সব শিক্ষার্থীই রয়েছেন। এসব আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে পারিবারিক কলহ, প্রেম, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পড়াশোনার চাপ, নি:সঙ্গতা, মানসিক চাপ ও তীব্র বিষন্নতা প্রভৃতি।
সর্বশেষ চলতি বছরের এসএসসিতে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে ৫ ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। গত বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) এ ফল প্রকাশ করার পর তারা আত্মহননের পন বেছে নেয়।
আরও পড়ুন: চৈতির মৃত্যু নিয়ে রহস্য, খুন নাকি আত্মহত্যা?
পরিসংখ্যান বিবেচনায়, মোট আত্মহননকারীর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী রয়েছে ১৩১ জন; মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছে ১৫ জন। আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে মিলে এ সংখ্যা ১০০ জন। অন্যদিকে আত্মহত্যাকারীদের বেশির ভাগেরই বয়স ১২ থেকে ২২ বছরের মধ্যে।
আরও পড়ুন: এক বছরে ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১২ মাসে বিভিন্ন প্রিন্ট ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যানটি তৈরি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
এ সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ৩৮ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে ৬ জনই ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে দীর্ঘ দেড় বছর শিক্ষার্থীরা গৃহবন্দী থাকায় তাদের মধ্যে নানা কারণে বেড়েছে হতাশা ও বিষণ্নতা। যার নানামুখী প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যেও। এসব কারণে কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন।
আঁচল ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত ‘আত্মহত্যা এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা— করোনায় তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিপর্যয়’ বিষয়ক এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালীন সময় তরুণ-তরুণীদের মানসিক চাপ বৃদ্ধির সর্ব মোট হার ৬৩.৫ শতাংশ। ওই জরিপে মোট অংশগ্রহণকারী ২ হাজার ২৬ জনের মধ্যে ১ হাজার ২৩৯ জন তরুণ-তরুণী বলেছেন যে তারা করোনাকালীন সময় বিষণ্নতায় ভুগছেন যার হার ৬১.২ শতাংশ। এছাড়া জরিপে অংশ নেয়া ২১.৩ শতাংশ তরুণ তরুণীরা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছে।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে ৫ ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। এদের মধ্যে খুলনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও নরসিংদীর একজন করে ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) বগুড়ার নন্দীগ্রামে কেয়া খাতুন নামের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। গত বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) ফল প্রকাশ করা হয়।
এর আগে গত বুধবার (২৯ ডিসেম্বর) খুলনা মহানগরীর খালিশপুরে মহুয়া খাতুন নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি খুলনা নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি একটি সুইসাইড নোট লিখে গিয়েছেন। তাতে পরিবারের এক সদস্যের প্রতি ঘৃণার কথা লিখেছেন। এছাড়া তার মৃতমুখ না দেখার জন্যও সেই সদস্যকে নিষেধ করেছেন সুইসাইড নোটে।
শুধু মহুয়া খাতুন নয় ২০২১ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ৩৮ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এদের মধ্যে ৬ জনই ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের। গত রবিবার (২৬ ডিসেম্বর) ঝিনাইদহের আদর্শপাড়ায় পাখি ডাক্তারের গলির এক বাসা থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা চৈতি সাহার মরদেহ গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থা উদ্ধার করা হয়।
আত্মহত্যার মিছিলে কলেজ পড়ুয়া ৯৩ শিক্ষার্থী
গত ২৫ ডিসেম্বর গাজীপুরের টঙ্গী আউচপাড়া মোল্লাবাড়ি রোড এলাকায় রত্না আক্তার (২৬) নামে এক কলেজছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সে এ বছর ফরিদপুর সিটি কলেজ থেকে ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিল। এ নিয়ে গত এক বছরে ৯৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এরমধ্যে উচ্চমাধ্যমিকের ছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে স্নাতক, ডিগ্রি ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী রয়েছেন।
স্কুল পড়ুয়া শতাধিক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
এসএসসির ফল প্রকাশের পর গত দুইদিনে (বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার) ৫ ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। এর আগে গত সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) রাতে নিজ ঘরে গলায় চাদর পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র আবদুল আউয়াল বাকের। এর আগে নিজের ফেসবুক ওয়ালে ‘আর ১০ মিনিট পর একজনকে শান্তি করে সব ছেড়ে চলে যাবো না ফেরার দেশে, ভালো থেকো প্রিয়’ স্ট্যাটাস দেয় তিনি। শুধু বাকের নয়। গত বছর স্কুল পড়ুয়া শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
সবচেয়ে কম মাদ্রাসার শিক্ষার্থী
গত বছর মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী সবচেয়ে কম আত্মহত্যা করেছেন। গত ১ জুলাই নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলায় কলি আক্তার (১৪) নামে এক শিক্ষার্থী ঘরের আড়ায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কলি আক্তার সদর উপজেলার বাগবেড় গ্রামের মো. ইসমাইল হোসেনের মেয়ে। বর্ণাকান্দা মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। সব মিলিয়ে গত বছর ১৫ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, করোনাকালে হঠাৎ করেই আত্মহত্যার হার বেড়েছিলো যা আমাদের গবেষণায়ও উঠে এসেছে। শিক্ষার্থীরা কেনো আত্মহত্যা করে এটা খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, বড় একটা অংশই ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগেছে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সংকটে ভুগে। খুব কম পরিবারই তাদের সন্তানের সব ধরনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। সবসময়ই একটা অদৃশ্য দেয়াল থাকে। এটা শুধু পরিবার নয় বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও একই রকম। একজন শিক্ষার্থী স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্রেশনে ভুগতে পারে সেটা আমাদের দেশের খুব কম শিক্ষকই বুঝতে পারেন।
তানসেন রোজ বলেন, হুট করেই একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যাপ্রবণ বা আত্মহত্যা করে না। অনেক দীর্ঘ সময় এবং অনেকগুলো ফ্যাক্টর তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণগুলো আমাদের কাছে ক্ষুদ্র মনে হতে পারে। এমনকি কিছু কিছু কারন হাস্যকরও লাগতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে হাস্যকর কারণগুলোর পেছনেও অনেক বড় কারণ লুকায়িত থাকতে পারে।
“যেমন একজন শিক্ষার্থীকে তার মা ভাত খেতে জোরাজুরি করায় আত্মহত্যা করে বসে। আমাদের কাছে কারণটা তুচ্ছ মনে হতে পারে। ভাত খেতে জোর করাটা হয়তো মূল কারণ না। বরং তার শরীর নিয়ে তার পাশের মানুষজন হয়তো বুলিং করতো আর ভাত খেতে জোর করাটা তাকে ট্রিগার্ড করেছে।”
তিনি বলেন, করোনা এখনো শেষ না হলেও আমাদের যেহেতু নিও নরমাল লাইফ শুরু হয়েছে তাই আমরা দেখছি শিক্ষার্থীদের মাঝে ডিপ্রেশন বা সুইসাইড বেশ উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন একটিভিটিতে জড়াচ্ছে, জবের সুযোগগুলোও বাড়ছে। পারিবারিক সমস্যাগুলোও কমা শুরু করেছে।
“আমাদের কাছে কাউন্সেলিংয়ের ক্লাইয়েন্টও আগের চেয়ে চল্লিশ শতাংশ কমেছে। তবে এটা যথেষ্ট নয়। আমরা চাই না কোনো শিক্ষার্থীই আত্মহত্যা করুক। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে একসাথে পদক্ষেপ নিতে পারলে আশা করি এই ভয়াবহ আত্মহত্যা মহামারী মোকাবেলা করা সম্ভব।”