দুই বোনের প্রেমের ফাঁদ: ব্ল্যাকমেইল করে লাখ লাখ টাকা আদায়

পুলিষের হাতে গ্রেফতার দুই বোন  পারভীন আক্তার নূপুর ও শেফালি বেগম
পুলিষের হাতে গ্রেফতার দুই বোন পারভীন আক্তার নূপুর ও শেফালি বেগম  © সংগৃহীত

গ্রামীণফোনের সার্ভার থেকে গ্রাহকের তথ্য চুরি করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে পারভীন আক্তার নূপুর ও শেফালি বেগম নামে দুই বোনকে আটক করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ।

বৃহস্পতিবার থেকে রোববারের মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, হাতিরঝিল এবং বাড্ডা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা প্রতারণা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুই মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

জানা গেছে, পারভীন আক্তার নূপুরের নেতৃত্বে চক্রের অন্য সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করে। টার্গেট ব্যক্তির সব ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে পরিবারের সব সদস্যকে জানিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে পাঁচ লাখ থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে।

এমনকি ভুয়া আইনজীবীর মাধ্যমে ফোন করে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণ মামলার হুমকি দিয়ে ভয় দেখানো হয়। এই চক্রকে টার্গেট করা ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করে গ্রামীণফোনের সার্ভিস সেন্টারের কর্মী রুবেল মাহমুদ অনিক।

পুলিশের হাতে আটক চক্রের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন গ্রামীণফোনের কর্মী রুবেল মাহমুদ অনিক এবং শামসুদ্দোহা খান বাবু। চক্রের আরেক সদস্য আইনজীবী পরিচয়দানকারী ইসা এখনও পলাতক।

এ প্রসঙ্গে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, ‘৫-৬ সদস্যের এই সংঘবদ্ধ চক্রটি উচ্চপদস্থ চাকরিজীবী, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের টার্গেট করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ষাটোর্ধ্ব বয়সের লোকজনই তাদের মূল টার্গেট। চক্রের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার ২০-২৫ জনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এই চক্রকে সমূলে উৎপাটনের পাশাপাশি এদের পৃষ্ঠপোষকদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। গ্রামীণফোন সার্ভিস সেন্টারে কর্মরত একজন স্টাফ, এই ব্ল্যাকমেইলিং চক্রের সদস্য হিসেবে টাকার বিনিময়ে যেভাবে সিম রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত একান্ত গোপনীয় তথ্যগুলো পাচার করছে। এমন হলে আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্যের নিরাপত্তা কোথায়? মোবাইল অপারেটরের কোনো গাফিলতি থাকলে বা এই তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেটাও খতিয়ে দেখা হবে’।

ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কৌশল:
প্রথমে টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে পারভীন। এক পর্যায়ে ওই ব্যক্তির পরিবারকে সব জানিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করে। গ্রামীণফোনের এক কর্মীর মাধ্যমে সিম রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহার করা ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে ব্ল্যাকমেইল করে তারা। পারভীন ক্লাস সেভেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তার কোনো পেশা নেই। পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে গুলশানের নিকেতনের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করে। তার বড় বোন শেফালী ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সে চাঁদনী চক মার্কেটে স্কার্ফ, হিজাব ও বোরকা বিক্রি করে। শামসুদ্দোহা মতিঝিল দৈনিক বাংলা মোড়ে পারফেক্ট ট্রাভেল এজেন্সিতে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে। অবিবাহিত শামসুদ্দোহা মোহাম্মদপুরে শেফালীর ফ্ল্যাটেই থাকে। রুবেল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন নাবিস্কো মোড়ে অবস্থিত গ্রামীণফোন সার্ভিস সেন্টারে কাজ করে। ইসা নিজেকে আইনজীবী ও একটি ল’ ফার্মে কাজ করে বলে পরিচয় দিয়েছে।

শামসুদ্দোহা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করার কারণে নিয়মিত বিদেশগামী ধনাঢ্য ব্যক্তিরা আসেন। তাদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এবং উচ্চপদস্থ চাকরিজীবীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে পারভীনকে দেয়। পারভীন নিজেকে কখনও সমাজকর্মী কখনও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহকারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে, চাকরির প্রার্থী বা সাংবাদিক পরিচয়ে এসব ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে। নানা অজুহাতে টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে। অনেক সময় ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর বা গোপন কথা বলে তা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে।

টার্গেট ব্যক্তির মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে পারভীন গ্রামীণফোন সার্ভিস সেন্টারে কর্মরত রুবেলের মাধ্যমে সিম রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত তথ্য সংগ্রহ করে। টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে পারভীনের বিয়ে হয়েছে এমন কথা পরিবারের সদস্যদের জানানোর হুমকি দেয়া হয়। দাবিকৃত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে পারভীনের বড়বোন শেফালী টার্গেট করা ব্যক্তিকে ফোন করে মামলার হুমকি দেয়। অনেকেই সম্মানের ভয়ে দাবিকৃত টাকা দিয়ে দেন। তবে কেউ দাবিকৃত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আইনজীবী পরিচয় দিয়ে ইসা ওই ব্যক্তিকে ফোন করে মিথ্যা ও বানোয়াট ধর্ষণ মামলা বা নারী নির্যাতন মামলা করার হুমকি দেয়। ইসা বিভিন্ন মিথ্যা ও বানোয়াট বিল ভাউচার তৈরি করার কথাও জানায়। এমনকি শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্গেট করা ব্যক্তিকে ফাঁসানোর জন্য নামকরা চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে পেসক্রিপশনে স্বামীর নাম অপশনে ওই ব্যক্তির (টার্গেট) নাম লিখে আনে পারভীন।

কয়েক মাসে পারভীন তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর এবং আরও কয়েকটি মোবাইল নম্বর থেকে ১৫-২০ জন ব্যক্তিকে টার্গেট করে ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অংকের অর্থ আদায় করেছে। এমনকি রুবেলের মোবাইল নম্বরে এসএমএসের মাধ্যমে ৬টি গ্রামীণফোন নম্বর পাঠিয়ে মোবাইল নম্বরধারী ব্যক্তির সিম রেজিস্ট্রেশন তথ্য (নাম, পিতার নাম, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, জন্ম নিবন্ধন নম্বর) জানতে চায় পারভীন। দশ হাজার টাকার বিনিময়ে রুবেল গ্রামীণফোন সার্ভার থেকে এ তথ্যগুলো সংগ্রহ করে হাতে লিখে পারভীনকে দেয়। পরে ইসাকে এসব তথ্য সরবরাহ করে পারভীন।

পারভীনের বিলাসবহুল জীবন:
পারভীনের দৃশ্যমান কোনো পেশা নেই। অথচ সে প্রায় এক লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে গুলশানের নিকেতনের একটি বাসায় থাকে। তার মেয়ের স্কুলের বেতন প্রতিমাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা। সে বনানীর ১১ নং রোডের ই-ব্লকের গ্রীন ডিলাক্স হাউজ নামের একটি জীমে নিয়মিত যায়। সেখানে প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা বিল দেয়। গুলশান থানায় সে একবার অভিযোগ করেছিল যে, তার ৬টি লিপস্টিক চুরি হয়েছে, যে ৬ টি লিপস্টিকের দাম ৯০ হাজার টাকা।


সর্বশেষ সংবাদ