রুম নম্বর ২০৫— ছাত্রলীগের পাপের সদর দপ্তর

সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাস ও অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা
সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাস ও অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা  © সংগৃহীত

সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় আলোড়ন চলছে দেশজুড়ে। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এজাহারভুক্ত ছয় নম্বর আসামি মাহফুজুর রহমানকে (২৫) সর্বশেষ গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সোমবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিলেট জেলা ডিবি ও কানাইঘাট থানা পুলিশের যৌথ অভিযানে তাকে হরিপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

তবে এমসি কলেজে ছাত্রলীগের অপকর্মের ঘটনা এটাই নতুন নয়। প্রতিদিনই সেখানে চলে অপরাধকর্ম। আর এই অপকর্মের কেন্দ্রস্থল ছাত্রাবাসের ২০৫ নম্বর কক্ষ, সব অপরাধের হেডকোয়ার্টার। সন্ধ্যা নামলেই সেখানে ছুটে আসতো বখাটে ও ছাত্রলীগ কর্মীরা। মাদক সেবন, নারীসঙ্গ সবই হতো। আশেপাশের শিক্ষার্থীরা সব জানতেন, কিন্তু প্রতিবাদ করতেন না। ওখানে যা হতো সব ‘বৈধ’।

এমসি কলেজের শতবর্ষী ছাত্রাবাসটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো আট বছর আগে। এরপর আগের আদলেই তা পুনঃনির্মাণ করা হচ্ছে, এখনো তা নির্মাণাধীন। তবে কর্তৃপক্ষ হলের দো-তলা ও তিন তলায় ছাত্র তুলেছে। প্রতি তলায় থাকেন ৩৬ জন। নিচে ডাইনিং, চতুর্থ তলা নির্মাণাধীন। ছাত্রাবাসের বাইরে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যা নামলেই অন্ধকার নেমে আসে।

হলের দোতলায় উঠলেই বাম পাশে আলোচিত ২০৫ নম্বর কক্ষ। ওই কক্ষেই বাস ছাত্রলীগ কর্মী শাহ মাহবুবুর রহমান রনির। তার নামেই বরাদ্দ সেটি। গত বছর সে মাস্টার্স পাস করলেও রুম ছাড়েনি। কক্ষটি দখলে রেখে অপরাধের আস্তানায় পরিণত করেছে সে। তার ভয়ে তটস্থ অন্য ছাত্ররাও। ওই কক্ষে এক ছাত্রকে ব্যাপক মারধর করা হয়েছিলো। এরপর থেকে কক্ষটি আতঙ্কের নাম।

কয়েকজন ছাত্র জানিয়েছেন, গত মার্চ থেকে ছাত্রাবাস বন্ধ থাকলেও রনি তার কক্ষেই থাকতেন। মার্চ থেকে থাকেন না হল সুপাররাও। কলেজ কর্তৃপক্ষও কিছু বলে না। বরং তারা যা করে সব যেনো বৈধ। ২০৫ নম্বরে আড্ডা দিতো সব ধর্ষক। তারা ইয়াবাসহ মাদক সেবন করতো, যা ইচ্ছা তাই করেছে। সন্ধ্যার পর বাইরে খোলা জায়গায় অন্ধকারময় ফাঁকা স্থানে বসে মাদক সেবন করতো।

পাশেই বালুচর, টিলাগড় থেকে ছাত্রলীগের কর্মীরা যেতো। রনির অবস্থানের কারণেই বাইরের কর্মীরা প্রবেশ করতো। দারোয়ানরাও ভয়ে তটস্থ ছিল। গত শুক্রবার ধর্ষণের ঘটনার সময় দারোয়ানরা দেখলেও প্রতিবাদ করেনি। বরং তারা দেখেনি বলে জানায়। ধর্ষণের পরপরই হলে যান কয়েকজন সাবেক নেতা।

তারা জানিয়েছেন, হলের সামনে অন্ধকার, বখাটেরা আড্ডা দেয়। তারা প্রায়ই ছিনতাই করে। নারীদের উত্ত্যক্ত করে। ধর্ষণ করলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। ঘটনার পর রাতেই শাহপরান থানা পুলিশ ২০৫ নম্বর কক্ষে অভিযান চালায়। সেখান থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, রনির কক্ষ ছিল অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু।

স্বামীর প্রাইভেটকারেই নববধূকে ধর্ষণ শুরু করে ছাত্রলীগ কর্মীরা!

এদিকে শাহপরান হলের চার নম্বর ব্লকে রয়েছে টিচার্স বাংলো। ওই বাংলোতে শিক্ষকদের থাকার কথা। কিন্তু তারা থাকতেন না। বাংলোটি দখলে ছিল আরেক ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমানের।আওয়ামী লীগ নেতা রণজিৎ সরকারের কর্মী সে। ধর্ষণের আসামি শাহ রনি, মাহফুজ, রবিউল, অর্জুনসহ সবার নিয়ন্ত্রক। বাংলো তার দখলে থাকলেও শিক্ষকরা প্রতিবাদ করেননি, বরং নীরব থেকেছেন।

ঘটনার দিনও শিক্ষক বাংলোতে গৃহবধূকে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কয়েকজন ছাত্র জানিয়েছেন, শিক্ষক বাংলোতে সাইফুর রাত হলেই অপকর্ম করতো। প্রায়ই অচেনা নারীরা তার বাংলোতে আসতো। টিলাগড়ের সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী মুন্না আহমদ জানান, ২০১৫ সালে সাইফুরের নেতৃত্বে একদল কর্মী তার মালিকানাধীন দোকানে ভাঙচুর ও ক্যাশ লুট করে। ওই সময় তিনি ডাকাতি মামলা করলেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি তাদের।

শিক্ষার্থীরা জানান, কলেজের অভ্যন্তরে মাদক, জুয়ার আড্ডার প্রতিবাদ করার কারণে ছাত্রলীগের উপরই তারা একাধিক বার হামলা চালায়। ঘটনার দিন শিক্ষক বাংলো থেকে সাইফুরের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। ওই আগ্নেয়াস্ত্র এমসি কলেজে সংঘর্ষে ব্যবহার করে সে। এছাড়া বেড়াতে যাওয়া লোকজনের সর্বস্ব ছিনতাই করতো তারা।

এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ উদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে তার অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে বলেন, হোস্টেলের সামনে বিদ্যুতের বাতি কে বা কারা নষ্ট করে ফেলে। আর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জ্যোর্তিময় সরকার জানান, হল থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ কারণে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে।


সর্বশেষ সংবাদ