মি টু: অভিযোগ সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধেও

  © টিডিসি ফটো

মি টু হ্যাশট্যাগ দিয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এবার বিখ্যাত নাট্যকার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রয়াত সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে।  বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন তারই এক সাবেক ছাত্রী।  নাম মুশফিকা লাইজু।

বাংলাদেশে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে গত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে সর্বপ্রথম মিস আয়ারল্যান্ড মডেল মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন।  এরপর চলতি নভেম্বর মাসে  শুচিস্মিতা সিমন্তি নামে আরেকজন তাঁর মায়ের এক সময়কার বন্ধু-সহকর্মী সাংবাদিক প্রনব সাহার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন।  একই অভিযোগ এসেছে পাঠক সমাবেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল ইসলাম বিজুর বিরুদ্ধেও।  তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন ট্রান্সজেন্ডার শিল্পী তাসনুভা আনান শিশির।  এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন দুই ছাত্রীও মুখ খোলেন। 

তবে সেলিম আল দিনের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগটি কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নামে আসা সর্বপ্রথম মি টু অভিযোগ।  পাঠকের জন্য মুশফিকা লাইজুর সেই স্ট্যাটাস হুবহু তুলে ধরা হলো- 

ফেসবুকে দেয়া মুশফিকা লাইজুর স্ট্যাটাস

 

#Me_Too : তি‌নি ছি‌লেন বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের শিক্ষক, নাট্যগুরু, আশ্চার্য।  এখনও প্র‌তিবছর তার ছ‌বি‌তে মালা ঝুলি‌য়ে তা‌কে মহান আখ্যা দেয়া হয়।  যেন বিষয়টা এমন মানুষ কোন রক‌মে তার জী‌বিত অবস্থায় কৃত পাপ অনাচার ঢে‌কেঢ‌ুকে ম‌রে গে‌লেই মহান হ‌য়ে যায়। দিন কতক ধ‌রে আ‌মি যখন ভাব‌ছিলাম যে আ‌মিও আমার প্র‌তি হওয়া ৩১ বছর আ‌গে যৌনহয়রা‌নির কথা #me_too তে লিখ‌বো অ‌নে‌কেই আমা‌কে পরামর্শ দি‌য়ে‌ছে না লিখ‌তে; কারন তি‌নি মারা গি‌য়ে‌ছেন, তা‌কে যেন ক্ষমা ক‌রে দেই, এখন আর লি‌খে ‌কি হ‌বে।  আ‌মি থামলাম এবং ভাবলাম ও সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম একজন নিযার্তনকারী কে মৃত্যু এ‌সে মহান ক‌রে দি‌তে পা‌রে না।  আর আজ য‌দি আ‌মি না লি‌খি ত‌বে আগামী পৃ‌থিবী আজীবন তা‌কে মহান বা‌নি‌য়ে রাখ‌বে কি জা‌নি আমার কন্যাও হয়‌তো তা‌কে এক‌দিন শ্রদ্ধাভ‌রে মালা দি‌তে যা‌বে মহান আচার্য্য হিসা‌বে !! 

আ‌মি ছিলাম অনাঘ্রাতা, ছোট্ট মফস্বল শহর থে‌কে উ‌ঠে আসা একজন ১৮ বছ‌রের মে‌য়ে , যার চো‌খেমু‌খে প্রগ‌তি আর সংস্কৃ‌তির আভা; চোখ ভরা স্বপ্ন‌ নি‌য়ে ভ‌র্তি হ‌য়ে‌ছি জাহা‌ঙ্গীরনগর বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ের নাটক ও নাট্যকলা বিভা‌গে।হ্যাঁ, আ‌মিই ছিলাম প্রথম ব্যা‌চের ছাত্রী। পাল্লায় প‌রে‌ছিলাম একজন ব্লাক ম্য‌াজে‌শিয়া‌নের, সে ছিল ঐ বিভা‌গের প্র‌তিষ্ঠাতা।  হ্যাঁ, আ‌মি প্রয়াত নাট্যাচার্য "সে‌লিম আল দী‌নের" কথা বল‌ছি। প্রথম বছর ঐ বিভা‌গে মোট সম্ভবত ১৭ জন ভ‌র্তি হ‌য়ে‌ছিল পরবর্তী‌তে ‌কেউ কেউ অন্য বিভা‌গে চ‌লে যাওয়‌তে শেষ পযর্ন্ত মোট ১১ জন ছিলাম এবং বলা বাহুল্য ক্লা‌সে আ‌মিই ছিলাম চটপটে এবং উজ্জল।  প্রথম দি‌কে ক্লা‌সের ম‌ধ্যে সে আমা‌কে উ‌দ্দেশ্য ক‌রে আমার প্র‌তিভার কথা বল‌তেন, ভ‌বিষ্যত শিক্ষক হওয়ার প্র‌লোভন দেখা‌তেন, আ‌মি ছিলাম গ্রাম্য এবং বন্য তার‌ এ ধর‌নের ইং‌গিত আ‌মি বুঝ‌তে পারতাম না।  কারন আ‌মি সদ্য যে সকল শিক্ষক‌দের স্কুল এবং ক‌লে‌জে ছে‌ড়ে এ‌সে‌ছি তারা ছি‌লে বাবা আর দেবতার মাঝামা‌ঝি জায়গায়।  তো এমন একজন শিক্ষ‌কের চ‌রিত্র নি‌য়ে প্রশ্ন আমার চিন্তারও অ‌তীত।  এক‌দিন তি‌নি ক্লা‌সে ই‌লিয়াড ও‌ডি‌সি নি‌য়ে একটা এ্যসাইন‌মেন্ট দি‌লেন এবং জিজ্ঞাসা কর‌লেন কে কে এই টেক্সবুক প‌ড়ে‌ছে? আমরা মোট ১১ জন ছাত্রছাত্রী ছিলাম।  ২ জন পড়ুুয়া হাত তু‌লে‌ছিল, যতদুর ম‌নে প‌রে তার ম‌ধ্য‌ে কামাল উ‌দ্দিন ক‌বির একজন ।তো ঐ শিক্ষকই ব‌লে‌ছি‌লেন তার কা‌ছে টেক্সবুক দু‌টো আ‌ছে, আমরা সবাই পযার্য় ক্রমে নি‌য়ে প‌ড়ে নি‌তে পা‌রি।  আ‌মি ছিলাম নবাব ফয়জুন নেসা হ‌লের আবা‌সিক ছা‌ত্রী।  আমার হল‌ ছিল তার বাসার (শিক্ষক কোয়াটার) কা‌ছেই।  তো তি‌নিই আমা‌কে উ‌দ্দেশ্য ক‌রে বল‌লেন বিকা‌লে ৫টায় যেন আ‌মি ব‌ই দু‌টো তার বাসা থে‌কে নি‌য়ে আ‌সি এবং পড়া শেষ ক‌রে এ‌কে এ‌কে সবাই‌কে দেই।  সম্ভবত ১৯৮৭ সা‌লের সে‌প্টেম্বর মাস হ‌বে।  অল্প অল্প শীত প‌ড়েছে, আ‌মি ঘ‌ড়ি‌ দে‌খে তার বাসায় উপ‌স্থিত হলাম তি‌নি দ‌রজা খুল‌লেন।  আমা‌কে ভিত‌রে গিয়ে বসার ঘ‌রে বস‌তে বল‌লেন, তি‌নি ভিতর থে‌কে বই দু‌টো নি‌য়ে এ‌সে আমা‌কে দি‌লেন, বাসাটা কেমন নি‌রিবি‌লি; আ‌মি ভাব‌তেও পা‌রি‌নি যে তি‌নি বাসায় একা (হয়‌তো) কারন আর কারও সাড়া পাই‌নি।  প্রথ‌মে তি‌নি আমা‌কে পড়াশুনার ব্যাপা‌রে ফালতু কিছু জিজ্ঞাসা কর‌লেন গৌড়চ‌ন্দ্রিকা দেয়ার জন্য, পড়াশুনায়‌ ম‌নো‌যোগ দি‌চ্ছিনা ব‌লে ভৎসনা কর‌লেন।  সং‌গে এও জান‌তে চাই‌লেন আমার গা‌য়ে‌ যে ওভার‌ কোট সেটা কোথায় পে‌য়ে‌ছি?

বললাম, বাবা বা‌নি‌য়ে পা‌ঠিয়ে‌ছেন, তখনকার সময় ক্যাম্পা‌সের কেউ এমন ধারার কোট প‌রে‌ছে ব‌লে দে‌খি‌নি।  আ‌মি ভে‌বে‌ছিলাম হয়তো আমা‌কে সুন্দর লাগ‌ছে তাই জান‌তে চাই‌ছেন।  বাস্তবতা ছিল আমার কো‌টে গলা থে‌কে হাটুর নিচ পযর্ন্ত বোতাম আটকা‌নো ছিল। অতগু‌লো বোতা‌মের পাহারা ভেদ ক‌রে আমার স্তন স্পর্শ করা দূরহ হ‌বে সেটাতে তি‌নি বিরক্ত হ‌য়ে‌ছি‌লেন। সর্ব‌মোট ৫ মি‌নিট সময় হয়‌তো আ‌মি সেখা‌নে ছিলাম আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমা‌কে নি‌দের্শ পাঠা‌চ্ছিল কিছু একটা ঘট‌তে যা‌চ্ছে আ‌মি উঠ‌তে যাব এরই ম‌ধ্যে তি‌নি আমা‌কে ঝাপটে ধর‌লেন, তার বি‌চ্ছি‌রি নোংরা ঠোট আমাকে দংশন কর‌ছিল এবং জোর চেষ্টা কর‌ছিল আমার কো‌র্টের বোতাম খোলার জন্য কিন্তু ‌ বোতামগুলো বড় ও বি‌শেষ কায়দায় লাগা‌নো ছিল ব‌লে একটা বোতামও তি‌নি সে‌দিন ছিড়‌তে পা‌রে‌নি, সৌভাগ্যবশত দু‌টো দরজাই খোলা (চাপান) ছিল।

মুশফিকা লাইজুর ওয়াল থেকে সংগৃহীত ছবি

আ‌মি কোন রক‌মে ছু‌টে ব‌ই দু‌টো তার দি‌কে ছু‌ড়ে মারলাম এবং পা‌লি‌য়ে বাচঁলাম।  নি‌চে নে‌মে দৌঁড়া‌তে লাগলাম।  আ‌মি যখন তার বাসার দি‌কে যা‌চ্ছিলাম তখন আমার বন্ধু মুন্না‌কে ব‌লে এ‌সে‌ছিলাম যে, স্যা‌রের বাসায় যা‌চ্ছি একটু প‌রেই ফি‌রে আস‌বো। মুন্না আমার জন্য প‌থেই অ‌পেক্ষা কর‌ছিল।  ও‌কে পে‌য়ে গেলাম, ও‌কে ধ‌রে কান্নায় ভে‌ঙে পরলাম।  ও ব‌লে‌ছিল তা‌কে ক্যাম্পা‌সে মার‌বে।  প‌রে মুন্না মত বদ‌লে‌ছিল কারন, "সে‌লিম আল দীন" ছি‌লেন তখনকার সময় ক্যাম্পা‌সের একজন প্রভাবশালী শিক্ষক। আ‌মি হো‌স্টে‌লে ফি‌রে গেলাম।  সারারাত সেই কোটটা প‌রেই থাকলাম।  চিৎকার ক‌রে কাদঁলাম।  থরথর ক‌রে কাপঁ‌ছিলাম ঘৃনায় ব‌মি ক‌রে ফেললাম।  শুধুই বাবার কথা ম‌নে পর‌ছিল।  ভাবছিলাম আজ বাবার দেয়া এই স্নে‌হের কোটটি আমা‌কে সম্ভাব্য ধর্ষণ থে‌কে বাঁ‌চি‌য়ে‌ছে।  পরে এক সপ্তাহ ক্লা‌সে গেলাম না, আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নিলাম।  বাবা‌কে দীর্ঘ চি‌ঠি লিখলাম।  সহপা‌ঠি ক‌বির, দোলন ও আলমকে জানালাম।  ও‌দের পরাম‌র্শে এক সপ্তাহ প‌রে স্যা‌রের চেম্বা‌রে গি‌য়ে তা‌কে আমার কা‌ছে ক্ষমা চাই‌তে বললাম।  উ‌নি আমা‌কে উ‌ল্টো ধমক দি‌লেন।  উনি এও জানা‌লেন যে, তিনি আমার জীবন ধ্বংস ক‌রে‌ দি‌তে পা‌রেন আমা‌কে রাজ‌টি‌কিট দি‌য়ে।  আ‌মি চিৎকার করলাম, উচ্চস্ব‌রে কাদঁলাম।  পা‌শের কক্ষে আফসার স্যার ছি‌লেন।  তিনি এ‌সে আমা‌কে শাস‌নের সু‌রে বের ক‌রে দি‌লেন।  বাই‌রে এ‌সে আ‌মি কান্নায় ভে‌ঙে পরলাম।

রু‌মের বাই‌রে আলম,‌ দোলন, মামুন এবং ক‌বির ভাই দা‌ড়িয়ে ছি‌ল।  আমা‌কে সবাই শান্তনা দি‌ল এই ব‌লে যে এর একটা বি‌হীত ওরা কর‌বে।  তার প‌রেরটা আ‌রো ভয়ঙ্কর, যথারী‌তি আ‌মি ক্লা‌সে যে‌তে লাগলাম।  কিন্তু উ‌নি ক্লা‌সে ঢুকেই প্রথ‌মে আমা‌কে ক্লাস থে‌কে বের ক‌রে দি‌তেন এবং যতগু‌লি এ্যসাইন‌মেন্ট জমা দেয়া ছিল সবগুলোতে ২০ এর ম‌ধ্যে ০ এবং ৯ নম্বর দি‌য়ে মু‌খের উপর ছু‌ড়ে দি‌তে থাক‌লেন।  তারপরও একমাস আ‌মি যথারী‌তি ক্লাসে উপ‌স্থি‌ত হই এবং পড়াশুনা চা‌লি‌য়ে যে‌তে থাকি।

সহপা‌ঠিরা আমার প্র‌তি হওয়া অ‌বিচার দে‌খে (য‌দিও মাত্র ১১জন) চুপচাপ থাক‌তো; কারন সবাই‌কেই প্রথম শ্রেনীর প্র‌লোভন দেখি‌য়ে রে‌খে‌ছি‌লেন, য‌দি প্রথম ব্যা‌চে কেউ প্রথম শ্রেনী পায় নির্ঘাৎ শিক্ষক হওয়ার সূর্বণ সু‌যোগ পা‌বে!! এই প্রলে‌াভন তা‌দের দি‌য়ে রে‌খেছিল । নি‌জের না‌র্ভের সা‌থে যুদ্ধটা আ‌মি চা‌লি‌য়ে যে‌তে পার‌ছিলাম না। 

‌দি‌নে দি‌নে আ‌মি ক্লান্ত হ‌তে থাকলাম। বিষন্নতা, হতাশা আমা‌কে ঘি‌রে ধরল। অব‌শে‌ষে কাউ‌কে না ব‌লে, হলে আমার সবকিছু রে‌খে একব‌স্ত্রে আমার স্ব‌প্নের জাহা‌ঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস ত্যাগ করলাম! তারপরের বিত্তান্ত অ‌নেক বিশাল।  আজ আর না লিখলাম য‌দি কোন দিন আমার প্র‌তি হওয়া এই যৌন হয়রানীর বিষয় একটা আস্ত বই লিখ‌তে পা‌রি সে‌দিন সবাই জান‌তে পার‌বে।  আ‌মি যখন পু‌রোপু‌রি ক্যাম্পাস ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছি তার একবছর (সময়টা ঠিক ম‌নে পর‌ছে না) পর কামাল উ‌দ্দিন ক‌বির ভাই (আমার সহপা‌ঠি) এ‌সে‌ছি‌লেন প্রস্তাব নি‌য়ে যে এই বিষয়‌টি নি‌য়ে আ‌মি আই‌নি লড়াই‌ কর‌তে চাই কি-না? তি‌নি সব কাগজপত্র তৈরি ক‌রে নি‌য়ে এ‌সে‌ছি‌লেন।  আ‌মিও রা‌জি ছিলাম কারন, আমার বু‌কের ম‌ধ্যে সব সময়ই দহন হ‌তে থা‌ক‌তো, যা আ‌জো অব্যাহত আ‌ছে।  কিন্তু আমার তখনকার প্রে‌মিক আমার সা‌থে একমত হ‌তে পা‌র‌লেন না।  তি‌নি স্পষ্ট ব‌লে দি‌লেন, এ যু‌দ্ধে তি‌নি আমার সা‌থে নেই।  যখন আমার শিক্ষা জীবন এভা‌বে থম‌কে গে‌লো, ঠিক তখনই আ‌মি আমার প্রেমকে হারা‌তে চাই‌ছিলাম না ।

তাছাড়া আ‌মি মফস্ব‌লের ১৯ বছ‌রের এক‌টি মে‌য়ে, ঢাকায় কিছু চি‌নি না। বা‌ড়ি‌তে এ ব্যাপা‌রে সাহায্য করার কেউ ছিল না। সব প্র‌তিকূলতার বিরু‌দ্ধে যুদ্ধ করার মত ম‌নোবল আমার ছিল না।  তখন এও উপলব্ধি ক‌রে‌ছি, যারা আমা‌কে আই‌নি লড়াই কর‌তে ব‌লে‌ছে তারা আস‌লে স‌ত্যিকা‌রের আমার অসম্মানের প্র‌তিকা‌রের জন্য আ‌সে‌নি।  এ‌সে‌ছিল আমার ঘটনাটা‌কে ইস্যু ক‌রে ঐ শিক্ষ‌কের প্র‌তি একটা চাপ সৃ‌ষ্টি করতে; যা‌তে তা‌দের প্রথম শ্রেণি পাওয়া সহজ হয়।

যে‌হেতু আ‌মি ঐদিন ধ‌র্ষিত হইনি, শুধুমাত্র আমাকে চু‌মু খাওয়া ও শরীর স্পর্শ করাকে কোনভা‌বে প্রমাণও কর‌তে পারতাম না।  সুতরাং আই‌নের কা‌ছে যাওয়ার আশা ছে‌ড়ে দিলাম।  শুধু ম‌নে ম‌নে ভিত‌রের আগুনটা জ্বা‌লি‌য়ে রে‌খেছিলাম, সম‌য়ের অ‌পেক্ষা ক‌রে‌ছিলাম জীবনকে একটু গু‌ছি‌য়ে ‌নি‌য়ে জনসম্মুখে একটা থাপ্পর মে‌রে বল‌বো এই আ‌মি সে‌দি‌নের শোধ নিলাম।  কিন্তু হায় এরই ম‌ধ্যে মরণ এ‌সে তা‌কে রেহাই দি‌য়ে গেল।

ত‌বে আ‌মি থে‌মে থা‌কি‌নি এর পরবর্তীতে উনার যে ছাত্রছাত্রী ও ভক্তকে পে‌য়ে‌ছি তা‌কেই ব‌লে‌ছি মাথা উঁচু ক‌রে যে আ‌মিই সেই মে‌য়ে যে কিনা যৌন হয়রানীর প্র‌তিবা‌দে নীর‌বে বিশ্ব‌বিদ্যালয় ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছি। বড়ই বেদনা হয় যে, সেই সময় ঐ বিভা‌গের শিক্ষক, ছাত্র আ‌রো অ‌নে‌কে এই ঘটনা জান‌তেন কিন্তু কেউ আমার পা‌শে এ‌সে দাড়াননি।  ধিক সেই সব জ্ঞান পাপী‌দের যারা মে‌নেই নি‌য়ে‌ছিল উনার একটু মদও নারী আস‌ক্তি আ‌ছে।  সেটা তেমন কোন ব্যাপার নয়।  মে‌নে নি‌য়েই উ‌নি মহান নাট্যকার, জাতীয় আচার্য্য ! ! 

ত‌বে ঐ ঘটনা আমার জীবনদর্শনকে পুরোপু‌রি বদ‌লে দি‌য়ে‌ছে।  আজ আ‌মি একজন নারীবান্ধব মানুষ। সকল বাঁধা অ‌তিক্রম ক‌রে আ‌মি পোড় খাওয়া জীবন যু‌দ্ধে হে‌রে যাওয়া নারী‌দের পা‌শে আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্য নি‌য়ে দাঁড়াই। এমন কি আ‌মি আমার পেশার পূর্ব প‌রিকল্পনা বদ‌লে পেশা হি‌সে‌বে বে‌ছে নি‌য়ে‌ছি নারী অ‌ধিকার কর্মী হিসা‌বে।  আমি লিঙ্গ বৈষম্য বিলু‌প্তি নি‌য়ে কাজ ক‌রি। 

‌সেদিন য‌দি ঐ শিক্ষকরূপী হায়না তার ক্ষুদ্র, তুচ্ছ যৌন ক্ষুধা ত্যাগ ক‌রে কন্যাসম ছাত্রী‌কে হয়রানি না কর‌তেন, ত‌বে আজ হয়‌তো আমার জীবন অন্যরকম হত।  হ‌তে পারতাম একজন প্র‌তিভাময়ী অ‌ভিনয় শিল্পী।  একজন র্নিমাতা, অথবা সৃজনশীল প্রজ্ঞাবান শিক্ষক।  শুধুমাত্র ঐ একটা অসুন্দর পাশ‌বিক সন্ধ্যা আমার জীবনকে এ‌নে দি‌য়ে‌ছে বিভৎস অসংখ্য দিন-রাত মাস-বছর।  ৩১ বছর ধ‌রে আ‌মি জ্বলন্ত আগুন বু‌কে নি‌য়ে ব‌সে আ‌ছি।  ভে‌বে‌ছিলাম জনসভা ক‌রে মাই‌কে সবাইকে আমার জীব‌নের গ্লানির কথা বল‌বো।  আ‌মার ম‌নে হয় আ‌মি আজও হয়‌তো আজ‌কের এই দিনটির জন্য বে‌ঁচে ছিলাম যখন #Me_too মুভ‌মে‌ন্টের মাধ্য‌মে জা‌নি‌য়ে দি‌তে পে‌রেছি আমার প্র‌তি হওয়া সেই অন্যা‌য়ের কথা।

আমার কন্যাও আগামী দি‌নের নৃত্য শিল্পী হ‌য়ে উঠ‌ছে।  হয়‌তো পড়‌তে যা‌বে বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ে।  আ‌মি আশা ক‌রি তা‌কে কোন শিক্ষ‌কের অথবা ভদ্র‌বে‌শী পুরু‌ষের যৌন লালসার শিকার হ‌তে হ‌বে না আ‌মি আমার বা‌কি জীবন প্রানপ‌ণে এই পৃথিবীর জঞ্জাল সরা‌তে সোচ্চার থাক‌বো।  আ‌মি আমার কন্যা‌র এবং সকল আগামী দি‌নের কন্যা‌দের জন্য যৌন হয়রানিমুক্ত পৃ‌থিবী রে‌খে যে‌তে চাই।  আর অনু‌রোধ সেই শুধী সমা‌জের কা‌ছে; একজন কুৎ‌সিত ‌নিকৃষ্ট মানুষ যেন আপনা‌দের কা‌ছে থে‌কে বর‌ণ্যের বরমাল্য না পায় । 

বিদ্র: আ‌মি কোন বিচার চাই না। শুধু এইটুকু প্রত্যাশা ক‌রি, যি‌নি বা যারা এখনও এই ধর‌নের নিপীড়‌নের সা‌থে যুক্ত আ‌ছেন তা‌দের বল‌ছি, দিন বদ‌লে গে‌ছে।  আগামী পৃাথবীর কা‌ছে সব পা‌পের, অন্যা‌য়ের হিসাব বু‌ঝি‌য়ে দি‌তে হ‌বে। 

#মি টু: ২০০৬-২০১৮

২০০৬ সালে আফ্রো আমেরিকান সামাজিক আন্দোলনের কর্মী তারানা বুরকি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নারীর উপর যৌন নিপীড়নের বিষয়ে প্রথমবারের মতো ‘মি টু’ ধারণার কথা বলেন, পরে একই নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় পরে হলিউড অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #মি টু আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এরপর একে একে মুখ খুলতে থাকেন হলিউডের অভিনেত্রীরা।  নীরবতা ভেঙে যৌন নিগ্রহের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান দিতে থাকেন নারীরা। 

সম্প্রতি এর ধাক্কা এসে লাগে ভারতেও।  শুধু রুপালি জগতেই নয়, রাজনীতিসহ অন্যান্য মাধ্যমেও যৌন নিপীড়নের কথা মুখ ফুটে বলতে শুরু করেছেন তারা। সেই ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়া শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। 


সর্বশেষ সংবাদ