মি টু: যৌন নিপীড়নের কথা জানালেন ঢাবির আরেক প্রাক্তন ছাত্রী

কানিজ ফাতেমা মিথিলা
কানিজ ফাতেমা মিথিলা  © সংগৃহীত

‘মি টু’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে যৌন হয়রানি নিয়ে মুখ খুললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আরেক প্রাক্তন এক ছাত্রী। তাঁর নাম কানিজ ফাতেমা মিথিলা। বর্তমানে তিনি নারী প্রগতি সংঘের প্রকল্প সমন্বয়ক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। সোমবার রাতে ফেসবুকে যৌন হয়রানি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন তিনি। 

এর আগে একই সময়ে মুমতাহানা ইয়াসমিন তন্বী নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রাক্তন এক ছাত্রীও ফেসবুকে যৌন হয়রানি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেন।

যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে মি টু হ্যাশট্যাগ দিয়ে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম অভিযোগ আনেন ২০১৪ সালের মিজ আয়ারল্যান্ড মডেল মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি। গত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। 

চলতি নভেম্বর মাসে  শুচিস্মিতা সিমন্তি নামে আরেকজন তাঁর মায়ের এক সময়কার বন্ধু-সহকর্মী সাংবাদিক প্রনব সাহার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন। অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হয়েছেন পাঠক সমাবেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল ইসলাম বিজুও। যৌন হয়রানির অভিযোগে সামনে এসেছে আরো দুই জনের নামও। তারা হলেন- ব্রাকের যাত্রি ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা জামিল আহমেদ এবং আবৃত্তিকার মহীদুল আলম। 

পাঠকের জন্য কানিজ ফাতেমা মিথিলা স্ট্যাটাস হুবহু তুলে ধরা হলো-

# metoo

পথেঘাটে, গণপরিবহনে, বাজারে, ভিড়ের মাঝে, নির্জন রাস্তায় আমরা যারা হামেশাই যৌন হয়রানির শিকার হই, তারা কাদের কাদের ছবি দেব? কার নাম প্রকাশ করব?

ঘটনা ১:
২০১২ সাল, পহেলা বৈশাখের দিন। তখন এটিএন নিউজে নিউজরুম এডিটর হিসেবে কাজ করি। শিফটিং ডিউটি। সেদিন শিফট ছিল বিকেল ৫টা-রাত ১টা। উত্তরা থেকে বাসে বিজয় স্মরণী পৌঁছানোর পর চালক সব যাত্রীদের নেমে যেতে বলল। রাস্তা বন্ধ। হাজারো মানুষ হাঁটছে, আমিও হাঁটা শুরু করলাম। ফার্মগেট পৌঁছানোর পর যখন দ্বিতীয় পদচারি সেতুর নিচ দিয়ে যাচ্ছি, ভিড়ের মধ্যেই ১০-১৫টা অল্পবয়েসি ছেলে আমাকে ঘিরে ধরল। সবার হাতে ভুভুজেলা। মুহূর্তের কি যে ঘটে গেল! কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেগুলো হাওয়া। ওইখান থেকে শরীরটাকে টেনে কিভাবে অফিস পর্যন্ত গিয়েছিলাম, মনে নাই। অফিস পৌঁছানোর পর কথা বলতে পারছিলাম না ঠিক মত।

ঘটনা ২:
২০০৯ সাল। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। বাড়ি ফেরার জন্য বাসের অপেক্ষায় শাহবাগে দাঁড়িয়ে আছি সন্ধ্যা ৭টা থেকে। সেদিন কোন কারণে বাস সঙ্কট ছিল। উত্তরাগামী কোন বাসই আসছিল না। ৪০-৪৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ একটা বাস সামনে আসতে চলন্ত অবস্থাতেই লাফিয়ে উঠে পড়ি। ওঠার পর বুঝলাম আমি একাই যাত্রী। চালক ছাড়া আরও ৩-৪ জন ছিল যারা সবাই বাসের কর্মী। আমি ওঠার পড় এরা নিজেদের মধ্যে কি যেন কানাঘুষা করছিল আর একটু পরপর পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত ভঙ্গিতে হাসছিল। আমার প্রবল অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। তারপর দু-একটা কথা কানে আসতে লাগল। একজন চালককে বলছিল, 'ওস্তাদ, ফার্মগেটে খাড়ানোর দরকার নাই। গেট লাগায় সোজা গ্যারেজের দিকে চলেন।' ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসল । স্থিরভাবে কিছু ভাবতে পারছিলাম না। একবার মনে হল, জানলা দিয়ে লাফ দিই। কিন্তু দেখি আতঙ্কে শরীর নাড়াতেও পারছি না। বাস কারওয়ান বাজার পার হয়ে ডেইলি স্টার ভবনের কিছু সামনে যানজটে আটকা পড়ল। আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে হুরমুড়িয়ে নেমে পড়লাম। নামবার সময় বাসে থাকা ৪ জন হইহই করে উঠল, 'আপনি না উত্তরা যাবেন?' ওইদিন ভাগ্য না অন্যকিছু আমাকে বাঁচিয়েছিল জানিনা। তবে কি হয়ে যেতে পারত, এই ট্রমা আমাকে দীর্ঘ সময় ভুগিয়েছে।

এ রকম আরও কত যে ঘটনা।

আমি সেই সৌভাগ্যবান নারীদের একজন, যাকে শৈশবে কোন কাছের মানুষের যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়নি। তবে ঘরে একা পেয়ে একবার এক প্রতিবেশি যুবক লুঙ্গি তুলে বলেছিল, 'আমারটা দেখালাম, এবার তোমারটা দেখাও।' তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি। অন্য আরেকজন চলে আসায় ঘটনা এরচেয়ে বেশি গড়ায়নি।

এলাকায় যেসব ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি, ক্লাস ফাইভে ওঠার পর এদের একজনের মধ্যে প্রেমিক জেগে উঠল। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে পথ আটকে দাঁড়াত, এটা সেটা কত কি বলত। এলাকায় সবাই পরিচিত বলে হয়তো কখনও গায়ে হাত দেওয়ার সাহস করেনি কিন্তু মুখে যা যা বলত! ওর ভয়ে রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। আমি নিচতলার যে ঘরটাতে থাকতাম, জানলাগুলো ছিল বড় বড় কাচের। দেয়ালের পাশেই ঘর, সহজেই দেয়াল টপকে আসা যায়। রাতে হাঁটাচলার শব্দ, পাতার খসখস শব্দ পেলেই ভয়ে সেই যে ঘুম ভাঙত, আর ঘুমাতে পারতাম না।

ফেসবুক স্ট্যাটাস

বড় হওয়ার পর কাছের একজনের কাছে যৌন নিপীড়নের শিকার হলাম, কয়েকবার। সে অবশ্য পড়ে তার ভুল বুঝতে পারে, তার গভীর অনুতাপ হয়, ক্ষমাও চেয়েছে বহুবার। কিন্তু আবার আমার নির্ঘুম রাত শুরু হল। রাতে ঘরের আলো নিভিয়ে যেই ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করতাম, কেন জানি না মনে হত, বলশালী পেশিবহুল এক পুরুষ আমার খাটের নিচে ছোরা হাতে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ করলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে রেইপ করবে তারপর মেরে ফেলবে। বারবার খাটের তল তন্ন তন্ন করে দেখতাম, নিজেকে বোঝাতাম এটা অকারণ ভয়। কোথাও কেউ নাই। কিন্তু যেই আলো নিভিয়ে চোখ বন্ধ করতে যেতাম, আবার সেই ভয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসতাম। কোনভাবেই ভয়টা মন থেকে তাড়াতে পারতাম না। দীর্ঘদিন এই ভয় আমাকে তাড়িয়েছে।

এই যে টানা মানসিক সব ইনজ্যুরি, এগুলোও কি যৌন নিপীড়ন না?


সর্বশেষ সংবাদ