‘জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ’ অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা সাবেক সমন্বয়কসহ অনেকের
আজ ৫ আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে। বিকেল পাঁচটায় সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, জুলাই শহীদ পরিবারের প্রতিনিধি ও আহত যোদ্ধাদের উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। পাশাপাশি, আয়োজন করা হয়েছে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। ঐতিহাসিক এই দিবস উদযাপনে দেশের শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, বয়োজ্যেষ্ঠ নারী-পুরুষ সবাইকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অনেকেই এই অনুষ্ঠান বর্জন ও জুলাই ঘোষণাপত্র প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর বাইরেও অনেকে অনুষ্ঠানটি বর্জন ও ঘোষণাপত্রের বিভিন্ন ধারার সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করছেন।
এ অনুষ্ঠান বর্জনকারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ আবদুল হান্নান মাসউদ। তিনি গত সোমবার (৪ আগস্ট) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, আগামীকাল (মঙ্গলবার) জুলাই ঘোষণাপত্র প্রদান অনুষ্ঠানে দাওয়াতের কার্ড পেলাম। শুনেছি এই সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের লেজিটিমেট বডি ১৫৮ জন সমন্বয়ক, সহ-সমন্বয়ককে দাওয়াত দিতে পারেনি, হয়ত কতগুলা আসন বসাবে, কিন্তু ১৫৮ জনের জন্যে জায়গা হবে না। জানিনা এই চেয়ারগুলোতে শহীদ পরিবারের জায়গা হবে কিনা!
তিনি বলেন, যাদের সাহসিকতায় আর নেতৃত্বে এই অভ্যুত্থান আর এই সরকার, বছর না পেরোতেই তারা মূল্যহীন। আমার সহযোদ্ধা, যারা মৃত্যুকে পরোয়া না করে হাসিনার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে- তারা এবং সকল শহীদ পরিবার তাদের প্রাপ্য সম্মান না পেলে, আমি আব্দুল হান্নান মাসউদ ব্যক্তিগতভাবে আগামীকালের জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রোগ্রাম বর্জন করার ঘোষণা দিচ্ছি।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম-সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ফেসবুকে এক পোস্টে বলেন, গতবছর আজকের এই দিনে আমি ঢাকায় একটা বাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলাম। ৩ তারিখ ছাড়া পাওয়ার পরেই পায়ে অপারেশান হয় (আহত হয়েছিলাম ১৭ তারিখ ক্যাম্পাসে পুলিশ আক্রমণে, হাজতে ক্ষতস্থানে পচন ধরতে শুরু করে)। ৫ তারিখে সকালে রুদ্ধশ্বাস যাত্রা (প্রায় ধরা পড়ে যাইতে নিচ্ছিলাম আবারো) শেষে ক্যাম্পাসে পৌঁছে লংমার্চে অংশ নেই। আমার বন্দী থাকার দিনগুলি বা আন্দোলনের দিনগুলি নিয়ে তেমন স্মৃতিচারণ করিনি। কারণ, এখন সে দিনগুলো নিয়ে ভাবলে যন্ত্রণা হয়। যথাসম্ভব ভুলে থাকার চেষ্টা করি।
আরও পড়ুন: গভীর রাতে জুলাই ঘোষণাপত্র অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা হান্নান মাসউদের
তিনি বলেন, ৫ তারিখ সংক্রান্ত কোন সেলিব্রেশনে আমি যাচ্ছি না। যারা দাওয়াত দিয়েছেন তাদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কিছু বিষয়ে আমাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এই সিদ্ধান্তগুলো আরো অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। সকলের কাছে এই ব্যাপারে দোয়া ও আশীর্বাদ কামনা করছি।
মেহেদী হাসান বাবু খাঁন নামে এক সাবেক সহ-সমন্বয়ক ফেসবুকে লেখেন, আজকের জুলাই ঘোষণাপত্র কাদের নিয়ে করা হয়েছে? কে বা কারা লিখেছে এই ঘোষণাপত্র? ওখানে কি কি বিষয় উল্লেখ আছে? এই ঘোষণাপত্র সম্পর্কে গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অফিসিয়াল নেতৃত্ব (তৎকালীন সময়ে যাদের নেতৃত্বে জনগণ গণঅভুত্থানে অংশ নিয়েছিল) অর্থাৎ, ১৫৮ জন সমন্বয়কের সবার সাথে আলোচনা করা হয়নি কেন? সবার মতামত নেওয়া হয়নি কেন?
তিনি বলেন, এটা জাতির সাথে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই না। গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে সুকৌশলে ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ নামক প্রহসনকে এবং এই প্রহসনের ঘোষণাপত্রকে আমি স্বেচ্ছায় প্রত্যাখ্যান করলাম।
আরও পড়ুন: জনআকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্রে রেখে ঘোষণাপত্র জারিসহ ১২ দফা দাবি আরিফ সোহেলের
হাফিজুর রহমান নামে একজন ফেসবুকে লেখেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের নামে তামাশা বন্ধ কর। ড. ইউনূসের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়নি।তিনি কেন জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন? ১৫৮ জন সমন্বয়ক ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সারা দেশের জনগণের মুখপাত্র।তাদের দিকে পুরো দেশ তাকিয়ে ছিল। জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করার সময় ১৫৮ জন সমন্বয়কের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল? তোদের এসব দোকান বন্ধ কর।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সমন্বয়ক ইব্রাহীম নিরব তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভ্যুত্থানকালীন নেতৃবৃন্দের (১৫৮ জন) প্রতি আবেদন, আপনারা মঙ্গলবারের প্রহসনের ঘোষণাপত্র প্রত্যাখ্যান করুন। জনগণের পক্ষ থেকে, সকল শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ, জাতিসহ জনগণকে সাথে নিয়ে নতুন ঘোষণাপত্র তৈয়ারীর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিন। যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ইতিপূর্বে ব্যর্থ হয়েছেন সেই ভ্রম সংশোধন করে, লুটেরা টাকাওয়ালা, দুর্নীতিবাজ আমলা আর উচ্চাভিলাষী বাটপারদের বিপক্ষে অবস্থান নিন, বাংলাদেশের আপামর বিপ্লবী ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক জনতার পক্ষে থাকুন। লুটেরা, কায়েমি ব্যবস্থার পক্ষে থেকে বিপ্লবী নেতৃত্বের মধ্য থেকে নিজেদের নাম খারিজ করবেন না। ইনশাআল্লাহ, বিপ্লবী ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত ঘোষণাপত্র তৈয়ার হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে থাকা মাওলানা শফিকুর রহমান ফেসবুকে লেখেন, শহীদদরা কখনো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে যেতে পারবে না। তো আমিও জীবন্ত শহীদ। আমিও আজকের এই পোগ্রামে অংশ গ্রহণ করব না। আমি আজকের এই পোগ্রামে যাচ্ছি না।
এদিকে, সোমবার রাতেই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে অনুষ্ঠেয় অনুষ্ঠানটি বর্জন করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশন। সংগঠনটির সভাপতি মশিউর রহমান খান রিচার্ড ও সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, আজ রাত ৯টা ১৫ মিনিটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে আমাদেরকে জানানো হয়েছে, তারা আগামীকালের (মঙ্গলবার) ‘জুলাই উদ্যাপন ও ঘোষণাপত্র প্রদান’ অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র পৌঁছে দিতে চান। আমরা মনে করি, এটি অভ্যুত্থানের বিভিন্ন পক্ষকে প্রতীকীভাবে অন্তর্ভুক্ত করার এক প্রচেষ্টা। তবে বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ইতোমধ্যে সাংগঠনিকভাবে এই কর্মসূচি বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।
তিনি আরও বলেন, বর্জনের পিছনে একাধিক কারণ থাকলেও, আমরা একটি মূল কারণকে সামনে আনতে চাই: অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার এখনো শহিদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি, আহত ও শহীদ পরিবারগুলোর যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে তাদের এই উদ্যাপন আয়োজনের নৈতিক অধিকার আমরা মানি না।