সিলেটের পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণাকারীরা ‘ধর্মের দাওয়াত দিতে গিয়েছিলেন’ বলে দাবি
বাংলাদেশে সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জের জনপ্রিয় 'উৎমাছড়া' পর্যটন স্পটে গিয়ে পর্যটকদের বের করে দেয়া এবং পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণার ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ঘটনার সাথে জড়িতরা বলছেন, 'তারা শুধু ধর্মের দাওয়াত' দিতে গিয়েছিলেন। ভিডিওতে একজনকে পর্যটন স্পটটি বন্ধ করে দেয়ার কথা বলতে শোনা গেলেও প্রশাসনের সাথে বৈঠকের পর তারা এখন বলছেন, 'পর্যটক আসা নিয়ে তাদের কোন আপত্তি নেই'।
যুব জমিয়ত নামে একটি ধর্মভিত্তিক সংগঠনের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুফতি রুহুল আমীন সিরাজি বলেছেন, 'ঘটনাটির সমাধান হয়েছে। পর্যটক আসুক। তবে স্থানীয়দের জন্য বিরক্তিকর কিছু যেন না হয় সেটি তদারকির অনুরোধ করেছি প্রশাসনকে'।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলছেন, পর্যটন স্পটটিতে আজ মঙ্গলবার বিকেলে গিয়েও তিনি বিপুল সংখ্যক পর্যটক দেখতে পেয়েছেন। স্থানীয় সব পক্ষের সাথে আমরা বসেছি। যারা বন্ধ করার কথা বলেছেন তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। পাশাপাশি সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য আমরাও প্রশাসনের তরফ থেকে কিছু ব্যবস্থা নিবো। তার মতে, ঘটনাটি একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ মুরব্বীদের সাথে কোনো আলোচনা না করেই ওই ব্যক্তিরা এটি করেছেন, তবে তারা তাদের ভুল স্বীকার করেছেন।
যদিও স্থানীয় এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের কিছু পর্যটন স্পটে সেখানকার মাদ্রাসাভিত্তিক কিছু লোকের তৎপরতা চোখে পড়ছে। তবে উৎমাছড়াতেই প্রথম প্রকাশ্যে তাদের কিছু বলতে শোনা গেছে।
প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার সবগুলো পর্যটন স্পটেই পর্যটকদের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয়দের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে নিয়মিত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন: অশ্লীলতা ও পরিবেশ নষ্টের অভিযোগে সিলেটের পর্যটনকেন্দ্র ‘বন্ধ ঘোষণা’ এলাকাবাসীর
মূলত পাহাড় থেকে নেমে আসা পানিতে সাদা পাথরের মেলা - এমন দৃশ্যের কারণেই এটি পর্যটকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। ওই এলাকার বাইরে থেকেও প্রতিদিন বহু নারী-পুরুষ সেখানে বেড়াতে যান এবং তাদের অনেকেই পাথরে স্বচ্ছ পানিতে নেমে আনন্দ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করেন। অনেকে আবার দল বেঁধে পিকআপ ও মাইক্রোবাস নিয়ে আসা যাওয়ার সময় উচ্চ শব্দে গান বাজনা করেন এমন অভিযোগও আছে।
ঈদের সময়টাতে পর্যটকদের ভিড় অনেক বেড়ে যায় বলে জানিয়েছে প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা। কিন্তু এবার ঈদের পরদিন পর্যটকদের অনেকে সেখানে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছেন। একটি ধর্মভিত্তিক সংগঠনের একদল ব্যক্তি সেখানে গিয়ে পর্যটকদের এলাকা ছাড়ার অনুরোধ করছেন এমন ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায় যে, এই এলাকার আলেম-ওলামা ও স্থানীয়রা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উৎমাছড়াকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে চলতে দেওয়া হবে না। তিনি পর্যটকদের উদ্দেশ্য বলছিলেন, এখানে মদ্যপান ও অশ্লীল কার্যকলাপের কারণে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তাই দয়া করে আপনারা এখান থেকে চলে যান। ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। কারণ ওই এলাকাটিতে অনেকে পর্যটনের ওপরেও নির্ভরশীল। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর আসার পর জেলা প্রশাসন থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দ্রুত তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়।
উপজেলা প্রশাসন ঘটনার সাথে জড়িত সংগঠনটির নেতাদের ছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে নিয়ে মঙ্গলবার একটি বৈঠকে বসে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলছেন, যারা পর্যটন কেন্দ্র চলবে না বলেছিলো বা পর্যটকদের চলে যেতে বলেছিলো, তারা তাদের ভুল স্বীকার করেছে। তারা প্রশাসনকে জানিয়েছে যে তারা 'ধর্মের দাওয়াত দিতে গিয়েছিলেন'। তারা আমাদের বলেছে যে তারা শালীনতার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে কিছু কথা বলেছে। কিন্তু সেটি এমন হয়ে যাবে তা তারা ভাবেননি। আমরা তাদের বলেছি কেউ কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে পারবে না। কোনো বিষয়ে সমস্যা হলে প্রশাসনকে জানাবে। প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান বিকেলে তিনি নিজেও ঘটনাস্থল থেকে ঘুরে এসেছেন ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তারা এলাকার মুরব্বী থেকে শুরু করে কারও সাথে আলাপ না করেই এসব করেছিলো। কিন্তু পরে আমাদের বলেছে যে পর্যটক আসায় কোন সমস্যা নেই। সবাই সহযোগিতা করবে। তবে তারা কিছু বিষয় তুলে ধরেছে। সেগুলো নিয়ে আমরা পর্যটকদের সচেতন করবো।
এদিকে রবিবার যারা পর্যটন স্পটে গিয়ে পর্যটকদের চলে আসতে বলেছিলেন, তাদের একজন হলেন ধর্মভিত্তিক সংগঠন যুব জমিয়ের স্থানীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রুহুল আমিন সিরাজী। তিনি জানিয়েছেন, প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান হয়েছে ও ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়েছে। আমাদের একটি টিম গিয়েছিলাম সেখানে ধর্মের দাওয়াত দেয়ার জন্য। আমাদের এক ভাই ভুলে পর্যটন কেন্দ্র বন্ধের কথা বলেছে। পর্যটক আসবে, আমাদের আপত্তি নেই।
কিন্ত দাওয়াত দিতে গিয়ে কেন তারা নিজেরা পর্যটকদের চলে যেতে বলেছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সিরাজী বলেন, অনেক সময় পর্যটকরা আসা যাওয়ার সময় উচ্চ শব্দে গানবাজনা করেন যেটি এলাকার মানুষের কাছে বিরক্তিকর। অনেক দিন ধরেই স্থানীয় লোকজন বলছিলো আমাদের কাছে। আমরা গিয়েছিলাম যাতে কোনো অসামাজিক কার্যক্রম না হয় বা অশালীন পোশাক কিংবা মাদক সেবন এগুলো না হয়-সে জন্য দাওয়াত দেয়ার জন্য।
তিনি আরও বলেন, এখন থেকে তারাও সহযোগিতা করবেন এবং প্রশাসনও তদারকি বাড়াবে- ফলে আর কোন সমস্যা হবে না বলে জানান তিনি।
উৎমাছড়া পর্যটন স্পটটি যে এলাকায় সেই এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোঃ ফারুক আহমদ বলছেন, তারাও আশা করছেন যে প্রশাসনের উদ্যোগের পর পর্যটকদের জন্য আর উদ্বেগের কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় মানুষ বেড়াতে আসে। এতে মানুষ আনন্দিত হয়। একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিলো। এখন তার অবসান হয়েছে। আশা করি আর কোনো সমস্যা হবে না।
সূত্র: বিবিসি বাংলা