চাকরিতে বয়স বৃদ্ধি ও বাঁচা মরার লড়াই
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:৫৩ PM , আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:৫৩ PM
দীর্ঘকাল ধরে সরকারি চাকরিতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে কিছু তরুণ ও যুবক আন্দোলন করে আসছে। যে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো গত নির্বাচনে ইশতেহারে সরকারি চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির অঙ্গীকার করেছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বয়স বাড়ানোর জন্য আলোচনাও হয়।
সংসদীয় কমিটি বয়স বৃদ্ধির সুপারিশও করে। কিন্তু বিভিন্ন ঠুনকো ও অযৌক্তিক কারণ দাঁড় করিয়ে তারুণ্যের সরকারি চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির দাবিকে উপেক্ষা করা হয়। এদিকে চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির দাবিতে যুবা তরুণরা নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে, সভা, মহাসমাবেশ,অবস্থান, জনসংযোগ, মানববন্ধন, সচেতনতা সৃষ্টি, অনশন ও স্মারকলিপি পেশ ইত্যাদি। এছাড়া পত্রিকায় লেখালেখি, টকশো, টিভি অনুষ্ঠানে বয়স বৃদ্ধির পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছে।
এসব কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ৩৫ এর আন্দোলনকারীরা গত ৬ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণঅনশন শুরু করে।একই সঙ্গে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র কল্যাণ পরিষদের ব্যানারে ১৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু করেছে আমরণ অনশন। তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে। প্রচণ্ড শীত ও শৈত্য প্রবাহ উপেক্ষা করে রাতদিন প্রেস ক্লাবের সামনে কর্মসূচি পালন করছে তারা।
এরমধ্যে অনেকে অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি। যাদের মধ্যে কয়েকজন নারী অনশনকারীও রয়েছে।জানা গেছে হসপিটালের ভর্তি কয়েক জনের শারীরিক অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে। বেশ কয়েকজনকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।
সাধারণ শিক্ষার্থী ও বেকারদের তরুণদের কথা মাথায় রেখে তারা চার দফা দাবিতে আমরণ অনশন চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম দফা: সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বৃদ্ধি করে ৩৫ বছরে উন্নীত করা।
দ্বিতীয় দফা: আবেদনে ৫০ ১০০ টাকার মধ্যে নির্ধারণ করা।
তৃতীয় দফা: নিয়োগ পরীক্ষা সমূহ জেলা বিভাগীয় পর্যায়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা।
চতুর্থ দফা: নিয়োগ পরীক্ষাগুলো তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে সম্পন্ন সহ সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বাস্তবায়ন করা।
সাধারণ শিক্ষার্থী ও বেকার তরুণদের এখন প্রাণের দাবি এই চারদফা। যদিও দাবিগুলো যুগোপযোগী ও মেনে নেওয়ার মতো। কিন্তু ২২ দিন ধরে দাবি আদায়ে তারা মৃত্যুর কাছাকাছি উপনীত হলেও রাষ্ট্রের এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আজ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে অনশনকারীরা কতটা উপেক্ষিত চিন্তা করা যায়? কনকনে শীতে ন্যায্য দাবিতে একদল ছেলেমেয়ে রাস্তায় দিনের পর দিন অবস্থান করছে অথচ রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে।
তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে কথা বলার যেন কেউ নেই। এমনকি কেউ প্রয়োজন বোধ পর্যন্ত করছেন না।ভাবতে অবাক লাগে। এই সেই চেতনার, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ? এই কথা বলার জন্য দুঃখিত যে রাস্তায় একদল কুকুর ঘেউঘেউ করলেও মানুষের আনাগোনা বাড়ে, কুকুরের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করে।
বড়ই দুর্ভাগ্য জাতির জন্য, দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষিত বেকার তরুণেরা দাবি আদায়ে রাস্তায় অবস্থান করছে, তাদের দেখার ও কথা শোনার মত যেন কেউ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রতিনিধি গিয়েও কি কথা বলতে পারে? তাদের আশ্বস্ত করতে পারতো?
তবে কেন কর্তা ব্যক্তিদের এই নির্লিপ্ততা? সাত এর মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছেন কিভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়, অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হয়। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবিকতার এক মহাকাব্যিক রচনা এই ঐতিহাসিক ভাষণ। অথচ এসব বাণী যেন আমাদের আর মোহিত করেনা। চেতনার কথা বলে অচেতন থাকি।
দিনের পর দিন বাংলা মায়ের সন্তান ন্যায্য দাবি আদায়ে রাস্তায় পড়ে থাকলেও তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাই না। দাবি মেনে নিতে গড়িমসি করি। এদেশে আপনাআপনি দাবি আদায় হয় না। হোক তা ন্যায্য কিংবা অন্যায্য। এর জন্য চাই লাশ, অনেক রক্ত। লাশ আর রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে হয় দাবি আদায়ের আপোষ মীমাংসা।হয়তো এই যুবা তরুণরা নিজের জীবন তুচ্ছ করে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেবে লাশ।
খালি হবে মায়ের বুক, কোন ভাই হারাবে সহোদর, বোন হারাবে ভাইয়ের স্নেহ। বাপের কাঁধে উঠবে সন্তানের লাশ। তারপর রাষ্ট্র নড়েচড়ে বসে দাবি মেনে নেবে। সেপথেই যেন হাঁটছে রাষ্ট্র ও অনশনকারীরা। এ দাবি এখন তাদের অস্তিত্ব রক্ষা ও বাঁচা মরার লড়াই।
ছাব্বিশ সাতাশ বছরে অর্জিত সনদ তিরিশ বছরেই শেষ, তা অকার্যকর, যা মেনে নিতেই তাদের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দম ফুরিয়ে আসছে। বাবা মা ভাই বোনের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারার কষ্ট তাদের খুবলে খুবলে খাচ্ছে। তারা সুযোগ চায়। করুণা নয়। ন্যায্য অধিকার চায়। পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ চায়। চাকরি চায় না। তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হোক। তাদের সেই সুযোগ কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্র তাদের আত্মহননের পথে ধাবিত করতে পারে না। এতো ঘোরতর অন্যায়। রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিরুদ্ধে চরম অবিচার।
শেষ করি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের কথা দিয়ে, ‘‘যদি উড়তে না পার, তবে দৌড়াও; যদি দৌড়াতে না পার, তবে হাঁটো; হাঁটতে না পারলে হামাগুড়ি দাও। যে অবস্থাতেই থাকো, সামনে চলা বন্ধ করবে না।’’ দাবি আদায়ে লেগে থাকলে একদিন তা আদায় হবেই, আজ কাল কিংবা পরশু।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক