২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:২২

৩ শর্ত থাকলে সহজেই চাকরি মিলবে জার্মানিতে

শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের স্বপ্নের গন্তব্য জার্মানি  © সংগৃহীত

ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানি। বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের স্বপ্নের গন্তব্য এই দেশ। তবু গত কয়েক বছর ধরে জার্মানিতে রয়েছে কর্মী সংকট। এ জন্য একটি প্রকল্প চালু করেছে জার্মান সরকার। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য জার্মানিতে গিয়ে বৈধভাবে কাজ করাটা সহজতর হবে।

সংকট সমাধানে গত ১ জুন থেকে ‘চান্সেনকার্টে’ বা ‘অপরচুনিটি কার্ড’ নামক প্রকল্প চালু করেছে জার্মান সরকার। এই কার্ডের মাধ্যমে যোগ্যতা অনুযায়ী যে কেউ বেছে নিতে পারবেন পছন্দের চাকরি। তবে এ পদ্ধতিতে যতটা সুবিধা রয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে সীমাবদ্ধতাও।

দেশটির এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর তিন থেকে চার লাখ দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে জার্মানি, আর এই মুহূর্তে দেশটির চাকরির বাজারে শূন্যপদ রয়েছে ২০ লাখ।

‘অপরচুনিটি কার্ড’ কী
অপরচুনিটি কার্ড অনেকটা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো পয়েন্টভিত্তিক ব্যবস্থার মতো। এর মাধ্যমে দক্ষ অভিবাসীদের জার্মানিতে আসার একটি সুযোগ দিচ্ছে দেশটির সরকার। এই উদ্যোগের অধীনে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা কোনো চুক্তিপত্র ছাড়াই এক বছরের জন্য জার্মানিতে থাকতে পারবেন এবং সেখানে থেকে চাকরি খুঁজতে পারবেন। 

যা বলছে জার্মান কনস্যুলার অফিস
জার্মান কনস্যুলার অফিসের এক বিবরণীতে বলা হয়েছে, অপরচুনিটি কার্ড হলো বসবাসের অনুমতি, যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কর্মীদের চাকরি খোঁজার জন্য জার্মানিতে প্রবেশ করতে দেবে। এটি জার্মানিতে বিদেশি পেশাজীবীদের যোগ্যতা শনাক্ত করারও একটি ব্যবস্থা।

ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়েছে, যোগ্যতা, জ্ঞান ও পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে কেউ অপরচুনিটি কার্ডের জন্য যোগ্য কি না, তা নির্ধারণ করতে একটি পয়েন্ট-ভিত্তিক ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়। যোগ্য বিবেচিত হতে ন্যূনতম ৬ পয়েন্ট প্রয়োজন। কারও যদি জার্মানিতে স্বীকৃত পেশাগত যোগ্যতা থাকে, তবে তিনি ন্যূনতম সংখ্যক পয়েন্ট অর্জন না করেও একজন স্বীকৃত দক্ষ কর্মী হিসেবে অপরচুনিটি কার্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন। উভয় ক্ষেত্রেই ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত মৌলিক শর্ত পূরণ করতে হবে।

আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে কেন পড়াশোনা করবেন?

চাকরি খোঁজার উদ্দেশ্যে দেশটিতে অবস্থানের সময় অপরচুনিটি কার্ডধারীরা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী খণ্ডকালীন চাকরির জন্য বিবেচিত হবেন এবং প্রতি সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে পারবেন। এর বাইরে তারা সেখানে নতুন চাকরি খুঁজে পেতে পরীক্ষামূলকভাবে দুই সপ্তাহ কাজ করতে পারবেন।

‘যোগ্য হলে আসুন আমাদের দেশে’
জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেসারকে উদ্ধৃত করে গত জুন মাসে বিবিসি জানিয়েছে, অভিজ্ঞতা আছে, এমন লোকদের জন্য উপযুক্ত চাকরি খুঁজে বের করা সহজ ও দ্রুত করে তুলবে অপরচুনিটি কার্ড।

জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলের (ডিডব্লিউ) তথ্য অনুযায়ী, ন্যান্সি ফেসার বলেছেন, জার্মান অর্থনীতিতে পরিশ্রমী ও দক্ষ কর্মী প্রয়োজন। তারা যোগ্য হলে আমাদের দেশে আসতে পারেন।

মৌলিক তিন শর্ত
১. একটি অপরচুনিটি কার্ড পেতে হলে অবশ্যই দেশের স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিধারী হতে হবে। অথবা দেশে স্বীকৃত কোনও কাজের ওপর দুই বছরের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে হবে।

২. অবশ্যই জার্মান ভাষায় দক্ষ হতে হবে, অথবা সাধারণ ইউরোপিয়ান ফ্রেমওয়ার্ক অব রেফারেন্স ফর ল্যাঙ্গুয়েজের (সিইএফআর) অধীনে বি-২ স্তরের জার্মান ভাষা দক্ষতা থাকতে হবে।

৩. আবেদনকারীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে জার্মানিতে চাকরি খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সেখানকার ব্যয় বহনের মতো আর্থিক সংস্থান রয়েছে। এ জন্য নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এই অর্থ জমা (ব্লক মানি) রাখতে হবে।

পয়েন্ট ব্যবস্থা
একটি অপরচুনিটি কার্ড পাওয়ার জন্য অন্তত ছয়টি পয়েন্ট থাকা প্রয়োজন। জার্মান সরকারি ওয়েবসাইট ‘মেক ইট ইন জার্মানি’র তথ্য অনুযায়ী—

শিক্ষাগত যোগ্যতা: জার্মান মান সমতুল্য শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলে চার পয়েন্ট দেওয়া হবে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতা আংশিকভাবে সমতুল্য হলেও দুই পয়েন্ট দেওয়া হবে।

পেশাগত যোগ্যতা: আপনি যদি এমন পেশায় যোগ্য হন, যেটিতে জার্মানিতে কর্মী ঘাটতি আছে, তাহলে আপনি এক পয়েন্ট পাবেন।

পেশাগত অভিজ্ঞতা: শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে পেশাগত যোগ্যতার মিল থাকলেও পয়েন্ট দেবে। এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ পাঁচ বছরের মধ্যে দুই বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতার জন্য দুই পয়েন্ট এবং সর্বশেষ সাত বছরের মধ্যে পাঁচ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতার জন্য তিন পয়েন্ট দেওয়া হবে।

ভাষাগত দক্ষতা: জার্মান ভাষায় এ-২ লেভেলের দক্ষতার জন্য থাকছে এক পয়েন্ট, বি-১ লেভেলের দক্ষতার জন্য দুই পয়েন্ট এবং বি-২ লেভেলের দক্ষতার জন্য তিন পয়েন্ট। এ ছাড়া সি-১ লেভেলের ইংরেজি ভাষার দক্ষতার জন্য বা ইংরেজি যাদের মাতৃভাষা, তাদের একটি অতিরিক্ত পয়েন্ট দেওয়া হবে।

বয়স: বয়স ৩৫ বছরের চেয়ে কম হলে দুই পয়েন্ট। আর ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের জন্য রয়েছে এক পয়েন্ট।

জার্মানিতে থাকার পূর্ব অভিজ্ঞতা: গত পাঁচ বছরের মধ্যে যদি বৈধভাবে শিক্ষাগত কারণে, ভাষাগত দক্ষতা অর্জন বা কোনও লাভজনক কর্মসংস্থানের জন্য অন্তত ছয় মাস জার্মানিতে অবস্থান করলে পাওয়া যাবে এক পয়েন্ট। তবে পর্যটক হিসেবে ও বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে জার্মানিতে থাকলে কোনও পয়েন্ট পাওয়া যাবে না।

সঙ্গীর আবেদন: যদি সঙ্গীর (স্পাউস) সঙ্গে একসঙ্গে অপরচুনিটি কার্ডের জন্য আবেদন করা হয় এবং ওপরের সব যোগ্যতা পূরণ হয়, তাহলে এর জন্য আরও এক পয়েন্ট দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন: মাথায় ক্যাপ, গায়ে টি-শার্ট, ইনফরমাল পোশাকে শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবরে ঢাবি ভিসি, অতঃপর...

সীমাবদ্ধতা
এই ‘চান্সেনকার্টে’ বা অপরচুনিটি কার্ড পাওয়ার পরও জার্মানিতে গিয়ে হতে পারে স্বপ্নভঙ্গ, যদি যথাযথ পরিকল্পনা না থাকে।

১. এক বছর বা ১২ মাসের ভেতরে ফুলটাইম চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। যদি দক্ষতা না থাকে তাহলে আবেদন করলেই যে চাকরি মিলবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই অনেকের জন্য এই ১২ মাস খুবই অল্প সময়। আবার অনেকের জন্য পর্যাপ্ত।

২. নিজ দেশে অবস্থানের সময় থেকেই পরিকল্পনা করে জার্মানিতে প্রবেশ করলে এ সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত চাকরি খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। আর যারা মনে করছেন আগে জার্মানিতে ঢুকে তারপর চাকরি পাওয়া যাবে, তাদের জন্য এই যাত্রা খুবই কঠিন হতে পারে।

৩. এই কার্ড নিতে হলে ন্যূনতম ১২ হাজার ৩২৪ ইউরো ব্লক করতে হবে। যা বাংলাদেশি টাকায় ১৬ থেকে ১৭ লাখ টাকা। তাই এই টাকা না থাকলে ভিসা পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।

৪. এই অপরচুনিটি কার্ড এমন কোনও ভিসা নয় যে জার্মানিতে আজীবন থাকা যাবে। এই পদ্ধতিতে এসে অনেককে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। ফুলটাইম কাজ পাওয়া পর্যন্ত ২০ ঘণ্টা কাজের অনুমতি থাকবে। ভালো কোনও চাকরি না পেলে নিজ দেশে ফেরত যেতে হবে।

৫. অবশ্যই এ-২ লেভের জার্মান ভাষা শিখতে হেবে। আর ইংরেজি সি-১ লেভেল ভাষা (৭.৫ স্কোর) জানতে হবে। যেকোনও একটি ভাষায় দক্ষতা থাকতে হবে।

৬. সিভি/রেজিউম অবশ্যই জার্মান ভাষায় লিখতে হবে। কাভার লেটার ইংরেজিতে লিখলেও চলবে। এ ছাড়া জার্মান ভাষায় ইন্টারভিউয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।

আরও পড়ুন: ৫ম গণবিজ্ঞপ্তি: চূড়ান্ত সুপারিশ পেতে যাচ্ছেন আরও ৮২ জন

এ বিষয়ে এক কনসালট্যান্ট বলেন, জার্মানির অপরচুনিটি কার্ড পদ্ধতি কানাডা, অস্ট্রেলিয়াতেও চালু আছে। সেসব প্রোগ্রামে বহু বাংলাদেশি মাইগ্র্যান্ট করেছেন। জার্মানির এই প্রোগ্রাম বাংলাদেশি দক্ষ তরুণদের জার্মানিতে গিয়ে চাকরি খোঁজার একটি বড় সুযোগ।

তবে নানা জটিলতাও আছে জানিয়ে তিনি বলেন, জার্মান শিল্প-প্রযুক্তির দেশ। এ মুহূর্তে তাদের এসব খাতে প্রচুর দক্ষ লোক দরকার। তাই এই প্রোগ্রামিংয়ের মতো বিষয়ে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশি সুযোগ পাবেন। অন্যরা তেমনটা পাবেন না। এ ছাড়া কাজের অভিজ্ঞতা ও ভাষা দক্ষতাও একটা চ্যালেঞ্জ। কার্ড পাওয়ার পর প্রায় ১৩ হাজার ইউরো অগ্রিম পাঠাতে হবে ব্লক মানি হিসেবে। তারপর বাংলাদেশে জার্মান দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। এখন দূতাবাসে ইন্টারভিউয়ের তারিখ পাওয়ার মেয়াদ থাকে ১৯ মাস। অন্যদিকে কার্ডের মেয়াদ এক বছর। যদি ইন্টারভিউর তারিখ পাওয়ার আগেই কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তাহলে তো এই কার্ড আর কাজে আসবে না।

এ জন্য অপরচুনিটি কার্ডের আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে জার্মান দূতাবাসে শুধু পাসপোর্ট দিয়ে ইন্টারভিউয়ের আবেদন করে রাখলে দ্রুত তারিখ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে বলে মনে করেন তিনি।

অপরচুনিটি কার্ড পাওয়া বা ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কোনও এজেন্সির সহায়তা প্রয়োজন কি না, এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অপরচুনিটি কার্ডের জন্য আবেদনকারীকে জার্মান ওয়েবসাইট পড়ে-বুঝে আবেদন করতে হবে। ভিসাসহ পরবর্তী সব ধাপ নিজেকেই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনও এজেন্সি যদি বলে তারা সমাধান করে দেবে, তাহলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ এই প্রোগ্রামে এজেন্সির কাজ করার কোনও সুযোগ রাখেনি জার্মান সরকার।

সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন, ১২ মাসের মধ্যে কোনও ফুলটাইম চাকরি না পেলে দেশে ফেরত আসতেই হবে। কিন্তু কেউ যদি জার্মানিতে পৌঁছেই অথবা ১২ মাসে চাকরির ব্যবস্থা না করে সে দেশে থাকার জন্য অ্যাসাইলাম অবেদন করে বসেন, সে ক্ষেত্রে তিনি তো বিপদে পড়বেনই, এই প্রোগ্রাম থেকে বাংলাদেশের নামও বাদ দেবে জার্মান সরকার।