বুক রিভিউ: শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’

  © টিডিসি ফটো

এটা শওকত ওসমানের তৃতীয় উপন্যাস। অনেকে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসও বলেন। শুরুতেই পাঠকগণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে ভুল করেন। আবার ঘটনাটিকে ঐতিহাসিক আবারণ দেয়ার জন্য লেখক যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছেন। তাই কিভাবে এটা আরব্য রজনীর আলিফ লাইলার একটি অতিরিক্ত গল্প হল, তারও একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আবিষ্কারের ঘটনার অবতারণা করে। তবে এটা কোনভাবেই কোন ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, তা পরবর্তীতে বোঝা যাবে।

ঘটনাটি মুসলিম খলিফা হারুন অর রশিদের অন্দর মহলের। খলিফার হাবসী ক্রীতদাস তাতারী ও আরমেনীয় দাসী মেহেরজান পরষ্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রেমে পড়ে। তাদের ভালবাসাকে স্বীকৃতি দেন রাজমহিষী। খলিফার অজান্তেই রাজমহিষী দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন। তারা খলিফার স্ত্রীর অনুমতিক্রমে প্রতিরাতেই দাসদের বসবাসের নির্ধারিত স্থানে মিলিত হত। এ দুই প্রেমিক-প্রেমিকা মিলিত হয়ে প্রাণখোলা হাসি হাসত।

এদিকে খলিফার মনে তেমন কোন শান্তি নেই। তারা ধন সম্পদ রাজ-ক্ষমতা সবই রয়েছে। কিন্তু তিনি মনের মধ্যে সব সময় একটি অস্থিরতাবোধ করেন। তিনি যেন হাসতেই ভুলে গেছেন। একদিন রাতের বেলায় বাগানে তার জল্লাদ-কাম সহচর মাসরুরসহ বেড়াতে গেলে সেখান থেকে ক্রীতদাসের হাসি শুনতে পান। পরের দিন তিনি গোপনে তাদের প্রেমলীলা প্রতক্ষ করেন। কিন্তু খলিফার অদ্ভূত খেয়াল হয় তিনি ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দিয়ে তাকে প্রয়োজনীয় শানসাওকাত দিয়ে তার প্রাণখোলা হাসি শুনবেন।

যে কথা সেই কাজ। রাতারাতি ক্রীতদাস তাতারী আমীর বনে যান। তাকে সুদৃশ্য বাগানবাড়িসহ দাসদাসী উপহার দেয়া হয়। তাকে দেয়া হয় প্রয়োজনীয় আনন্দ উপকরণ। তবে ক্রীতদাসের বাইরে যাবার কোন সুযোগ থাকে না। তাকে তার প্রেমিকা মেহেরজানের সঙ্গ-বঞ্চিত করা হয়। এ সব কিছুর বিনিময়ে খলিফা ক্রীতদাসের কাছ থেকে প্রাণখোলা হাসি শুনতে চান। দ্বিতীয় দিনের খলিফা তার কবি আমাত্য আতাহিয়া ও নওয়াসকে নিয়ে ক্রীতদাসের হাসি শোনার জন্য তার নতুন আবাসে উপস্থিত হন।

কিন্তু প্রিয়ার বিরহে ক্রীতদাস হাসতে ভুলে যায়। সে আর প্রাণখোলা তো দূরের কথা সামান্য হাসিও হাসতে পারে না। সে আনন্দ ভুলে গেছে। তার অন্তরে আর হাসির কোন উপাদান নেই। তাই তার পক্ষে আর হাসা সম্ভব হয়না। অথচ খলিফা তাকে হাসার নির্দেশ দিয়েছেন, হাসার জন্য অনুরোধ করছেন। খলিফা এতে অপমানিত বোধ করেন। তবুও খলিফার আশা ক্রীতদাস হয়তো শেষ পর্যন্ত হাসবে।

তাই তাতারীকে তিন দিন সময় দেন খলিফা যাতে তিনি ধাতস্থ হয়ে খলিফাকে হাসি শোনাতে পারেন। এজন্য বাগদাদের সবচেয়ে সুন্দরী ও আবেদনময়ী নর্তকীকে তাতারীরর মহলে পাঠান হয়। সে তাতারিকে তাকে উপভোগ করাতে ব্যর্থ হয়। বরং তাতারীর সদাচারণ নর্তকীকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনে। সে নাচগান ও দেহদান ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এতে তো তার বিপদ। এজন্য খলিফার কাছ থেকে সে কঠিন শাস্তি পাবে। তাই খলিফার রোসানল থেকে বাঁচার জন্য সে আত্মহত্যা করে।

কিন্তু এ আত্মহত্যাকে হত্যা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে তার দায়ভার ক্রীতদাসের উপর অর্পণ করা হয়। তার বিচার করা হয়। খলিফার এই নির্দয়তায় আপত্তি তোলেন কবি নওয়াস। তিনি খলিফাকে ভুল বিচার করার অপবাদ দিয়ে খলিফার বিরাগভাজন হন।তাকে রাজ দরবার থেকে বহিষ্কার করা হয়।

তবে খলিফা তাতারীকে আরো তিন বছর সময় দেন যাতে তিনি খলিফার মনোবাসনা সেই হাসিটুকু উপহার দেন। কিন্তু ক্রীতদাস হাতারি কোনভাবেই খলিফাকে হাসি উপহার দিতে পারেন না। এজন্য তার উপর চলে দিনের পর দিন অত্যাচার। কিন্তু ক্রীতদাস হাসি দেয়া তো দূরের কথা কোন প্রকার কথাই বলেন না। সকল প্রকার অত্যাচার-নির্যাতনে নিরব থাকেন।

কৌশল হিসেবে পরে ক্রীতদাসের কাছে তার প্রেমিকা মেহেরজানকে নিয়ে আসা হয়। খলিফার আশা তার প্রেমিকাকে দিয়ে হয়তো বুঝিয়ে সুজিয়ে ক্রিতদাসের মুখে হাসি উৎপাদন করা যাবে। কিন্তু মেহেরজান ততো দিনে আর ক্রীতদাসের প্রেমিকাতে থিতু নেই। সে এখন খলিফার স্ত্রীতে পরিণত হয়েছে। সে এখন আমিরুল মোমেনিন। প্রথমে মেহেরজান তাতারীকে চিনতেই পারে না। কিন্তু পরে চিনতে পারলেও তার প্রাক্তন প্রেমিককে কোন কথাই বলাতে পারেন না। সেও ব্যর্থ হয়।

মেহেরজান চলে যাওয়া শুরু করলে ক্রীতদাস তাতারি মুখ খোলে। মেহেরজানকে পিছু ডাক দেন। তারপরই খলিফাকে বলেন, ‘শোন হারুন রশিদ’!

খলিফকে যথাযথ সম্মান না জানানোর জন্য সবাই তার উপর খেদোক্তি করে। তার শরীরে শাস্তির কোড়া চলতে থাকে। কিন্তু ক্রীতদাসের তাতে কোন বিকৃতি আসে না। ক্রীতদাস বলতে থাকে:

শোন, হারুনর রশীদ। দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব –। কিন্তু – কিন্তু—ক্রীতদাসের হাসি – না – না—না—না। এরপরই তার মৃত্যু হয়।

এ পর্যায়ে কবি নওয়াস প্রবেশ করে মন্তব্য করেন: আমিরুল মোমেনিন, হাসি মানুষের আত্মারই প্রতিধ্বনি।

উপন্যাসটি চমৎকার! কিন্তু এটা সঠিক উপন্যাস না নাটক এ নিয়ে বড় খটকা জাগে। তবে এটা দুইয়েরই সংমিশ্রণ। কাহিনীটি ঐতিহাসিক মোড়কে হলে এর সাথে প্রকৃত ইতিহাসের কোন সংযোগ নেই। আর ঘটনাটি খলিফা হারুনর রশীদের দরবারের হলেও এটা যে বাংলার মানুষের পরাধীনতারই কাহিনী এটা সহজেই বোঝা যায়। তবে ঐ সময়ের পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ূব খান তা বুঝতে পারেননি। এটি আদমজী পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হলে খোদ আইয়ূব খানই লেখককে নিজহাতে পুরস্কার তুলে দেন।

তবে সামরিক শাসকদের বোঝার ক্ষমতা ছিল না যে এ উপন্যাস বাংলার পরাধীন মানুষকে ক্রীতদাসের অবস্থা থেকে স্বাধীনতার দিকে উদ্বুদ্ধ করবে। এর প্রায় আট বছর পর বাংলার তাতারীরা পাকিস্তাননের খলিফা ইয়াহিয়া খানকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

তবে সত্য বলতে কি শওকত ওসমানের জননী উপন্যাস আমাকে যেভাবে আবেগতাড়িত করে, ক্রীতদাসের হাসি সেভাবে করে না। আমার পঠিত শওকত ওসমানের তিনটি উপন্যাস, বণী আদম, জননী ও ক্রীতদাসের হাসির মধ্যে জননীই শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence