১৫ মার্চ ২০১৯, ২২:৫৩

শিক্ষায় শাস্তির প্রয়ােজন সামান্যই

শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়া নিয়ে এখন নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা চলছে  © টিডিসি ফটো

ব্রিটিশ দার্শনিক, গণিতবিদ ও সমাজকর্মী বার্ট্রান্ড রাসেল। আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা, ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ কেমন হওয়া উচিত তা আলোচনা করেছেন তাঁর ‘অন এডুকেশন’ বইয়ে। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। এ বইয়ের একটি অধ্যায়ে শিক্ষা জগতে শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থীদের শাস্তির ব্যবস্থা কেমন হতে পারে তার উপর বিশ্লেষনধর্মী আলোকপাত করেছেন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী এ লেখক। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য দুই কিস্তিতে তা তুলে ধরা হলো। আজ এর প্রথম কিস্তি। 

আগেকার দিনে এবং বর্তমান সময়ে কিছু দিন আগে পর্যন্ত শিশু এবং বালক-বালিকাতে শাস্তি দেয়া একটি অতি সাধারণ ব্যাপার বলে প্রচলিত ছিল। এ ধরনের শাস্তি দেয়া শিক্ষার জন্য সর্বজনীন এবং অপরিহার্য বলে মনে করা হতো। পূর্ববর্তী একটি অধ্যায় ছাত্রদেরকে বেতমারা সম্পর্কে ড: আর্নল্ডের অভিমত নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। তার সময়ে ড. আর্নল্ডের অভিমত অতি কোমলতাপূর্ণ বলে বিবেচিত হতাে। রুশাে শিশুকে তার নিজের স্বভাব ও প্রকৃতি অনুসারে বেড়ে উঠতে দেয়ার নীতি প্রচার করেন। তথাপি তিনি তার Emile বইয়ে কখনো কখনো শিশুকে কঠোর শাস্তি দানের পক্ষে মত দিয়েছেন।

একশত বৎসর পূর্বে শিশুর শাস্তি সম্পর্কে কি মত চালু ছিল তা তখনকার সতর্ককারী গল্পগুলাে (Cautionary Tales) তে চালু আছে। একটি ছোট্ট মেয়ে সাদা জামা পড়ানাে হচ্ছে, কিন্তু সে ফিকে লাল রঙের পড়ার জন্য বায়না ধরেছে। এর ফলস্বরূপ : “বাবা যখন বৈঠকখানা থেকে এসে দেখলেন যে ভেতরে খুব হৈচৈ আর কোলাহল হচ্ছে, তখনই তিনি মেয়েটির কাছে ছুটে গেলেন এবং তাকে বেত মারলেন, এ ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই।”

The Fairchild বইয়ে Mr Fairchild তার শিশুদেরকে নিজেদের মাঝে ঝগড়া করতে দেখলে বেত মারার তালে তালে কবিতা আবৃত্তি করতাে “কুকুর আনন্দ পাক কামড়ে আর গর্জনে” [Let dogs delight to bark and bite]। তারপর ফাসির কাঠের সঙ্গে ঝুলানাে মরদেহ দেখানাের জন্য নিয়ে যেতাে। ছােট বাচ্চারা ভয় পেতাে, বাতাসে ফাসির শিকলের ঝনঝন শব্দ হতাে। এর ফলে ছােট বাচ্চারা তাদেরকে বাড়ি ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনুরােধ করতাে। কিন্তু মি: ফেয়ার চাইল্ড তাদেরকে বহুক্ষণ এ দৃশ্য দেখতে বাধ্য করতাে এবং বলতাে, যাদের অন্তরে ঘৃণা আছে তাদের অবস্থা এমনই হয়।

পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ধর্মযাজক করা এবং এ উদ্দেশ্যেই হয়তাে তাকে এমন শিক্ষা দেয়া দরকার ছিল, যাতে সে পাপীর অপরাধ যে কিরূপ ভীষণ হয় সে সম্পর্কে যেন পরে প্রত্যক্ষদর্শীর মতাে জ্বলন্ত বর্ণনা দিতে পারে। বর্তমান যুগে খুব কম লােকই এরূপ শাস্তি সমর্থন করবে। কিন্তু এর পরিবর্তে কিরূপ শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত সে সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ উল্লেখযােগ্য পরিমাণে শাস্তিদানের পক্ষপাতি, আবার কেউ কেউ তা সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়ার পক্ষপাতি—এ দুটোই চরম মতবাদ।

আমার মনে হয় যে, শিক্ষায় শাস্তির সামান্যই প্রয়ােজন আছে, কিন্তু কঠোর শাস্তি মােটেই বাঞ্ছনীয় নয়। অত্যন্ত কড়াভাবে কথা বলা বা বকাবকি করাটাকেও আমি শাস্তি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করি। যদি কখনো কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করতে হয়, তবে এ জন্য স্বাভাবিক ক্রোধ প্রকাশই যথেষ্ট হওয়া উচিত।

আমার ছেলে কয়েকবার তার ছােট বােনের ওপর রূঢ় ব্যবহার করলে তার মা রেগে বিরক্তির সঙ্গে জোরে ধমক দেন। এর ফলাফল খুবই ভালাে হয়েছে। ছেলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলাে এবং তার মা তাকে আদর না করা পর্যন্তু সে শান্ত হলাে না। আর ছোট বােনের সঙ্গে তার ভালাে আচরণ লক্ষ্য করে বােঝা গেলাে যে, তার মায়ের রাগের ব্যাপারটি তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। আমরা যখন আবদার প্রত্যাখান করেছি তখন সে জিদ ধরলে কিংবা তার বােনের খেলায় বাধা দিলে, এরকম কয়েকটি উপলক্ষ্যে তাকে মৃদু শাস্তি দিতে হয়েছে।

এরকম পরিস্থিতিতে শিশুকে ভালোভাবে বোঝালেও কোন ফল না হলে আমরা তাকে একটি একাকী ঘরে রেখে আসতাম। ঘরের দরজা খোলা থাকতো। তাকে বলা হতাে যে, ভালাে হলেই সে চলে আসতে পারে। সে কয়েক মিনিট জোরে চিৎকার করে কাঁদতাে, তারপর শান্ত হয়ে বেরিয়ে আসতাে এবং ভাল ব্যবহার করতাে। সে এটা ভালােভাবেই বুঝতে পারে যে, বাহিরে আসার ফলে সে ভালাে আচরণের শর্ত মেনে নিয়েছে। আমাদের এর চেয়ে কোনাে কঠোর শাস্তি প্রয়ােগের প্রয়ােজন পড়ে নি।

যারা কঠোর শাস্তি দিয়ে শিশুকে শায়েস্তা করতে চান এমন প্রাচীনপন্থী শৃংখলা-বিধানকারী ব্যক্তিদের বই পড়ে বােঝা যায় যে, বর্তমান প্রণালীতে শিক্ষিত শিশুদের চেয়ে প্রাচীন প্রণালীতে শিক্ষিত শিশুরা অনেক বেশি দুষ্ট ছিল।

আরো পড়ুন: শিক্ষকের শ্লীলতাহানির ভয়ে শিশু ছাত্রীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ! 

The Fair Child Farhaily বইয়ে শিশুদের যেরূপ আচরণের কথা বলা আছে, আমার ছেলে তার অর্ধেক খারাপ আচরণ করলেই আমি ভীত হব। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করব যে, শিশুর এ ধরনের আচরণের জন্য পিতা মাতার দোষই বেশি। আমি বিশ্বাস করি যে, বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন পিতামাতাই বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন সন্তান গড়ে তুলতে পারেন। শিশুদের জীবন গঠনের জন্য পিতা মাতার স্নেহ প্রয়োজনীয়।

সন্তানের প্রতি পিতা মাতার কর্তব্য ও দায়িত্ব সন্তানগণ বুঝে না, এর জন্য তারা কৃতজ্ঞও থাকে না। যখন সন্তানকে কোনাে কারণে কোনাে কিছু করতে নিষেধ করা হয় বা কোনাে আচরণ থেকে বিরত রাখতে হয়, তখন এর কারণ তাকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এবং সত্যনিষ্ঠ ভাবে বুঝিয়ে বলা উচিত।

খেলাধুলায় ছােটাছুটির ফলে শিশুর গায়ে সামান্য আঁচড় লাগতে পারে কিংবা হালকাভাবে কিছুটা কেটে যেতে পারে, তথাপি তাদেরকে এটা করতে নিষেধ করা উচিত নয়। এরূপ কিছু কিছু অভিজ্ঞতা থেকে তারা উপলব্ধি করতে পারে যে, নিষেধ মেনে চলা বুদ্ধিমানের কাজ। যেখানে প্রথম থেকেই  শিশুরা এরূপ অবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষা পেতে থাকে, সেখানে গুরুতর শাস্তি পাওয়ার যােগ্য কোনাে কাজ তারা আদৌ করবে না।

শিশু যখন জেদ করে ক্রমাগতই অন্য শিশুদের খেলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কিংবা অন্যদের আনন্দে বাধা দেয়, তখন শাস্তিস্বরূপ তাকে অপর শিশুদের কাছ থেকে পৃথক করে রাখা উচিত। এ ধরনের কাজে শাস্তি দিতেই হবে, কারণ একজনের দুষ্টুমির জন্য অন্য সকলের আনন্দে বাধা দেয়া ঠিক নয়।

কিন্তু এমন কোনাে শাস্তি দেয়ার প্রয়ােজন নেই যার ফলে তার মাঝে এ মনােভারের সৃষ্টি হয় যে, সে বিশেষভাবে দোষী। যদি সে বুঝতে পারে যে, অন্যেরা যে আনন্দ ভােগ করছে সে তা থেকে বঞ্চিত তবেই যথেষ্ট। এরূপ ক্ষেত্রে ম্যাডাম মন্তেসরি কি ব্যবস্থা অবলম্বন করেন, তা তিনি বর্ণনা করেছেন : “আমরা অনেক সময় এমন শিশুদের সংস্পর্শে এসেছি, যারা কোনো রকম সংশােধনে কান না দিয়ে অন্যের আনন্দে বাধা সৃষ্টি করেছে। এরূপ শিশুকে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করা হয়।

আরো পড়ুন: মারধর করা শিক্ষকের শাস্তি চান না শিশুটির মা-বাবা

যখন দেখা যায় যে, তাদের শারীরিক কোনাে অসুস্থতা নেই, তখন তাকে ধরে কোনে ছােট একটি টেবিলে বসিয়ে অন্যের নিকট থেকে দূরে পৃথক করে রাখা হয়। তাকে ছোট একটি হাতাওয়ালা আরাম চেয়ারে এমনভাবে একটু উঁচুতে বসানাে হয়, যাতে সে তার সঙ্গীদের খেলা দেখতে পারে। যেসব খেলনা সে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে, তাই তাকে খেলতে দেয়া হয়।

এ প্রক্রিয়া প্রায় সবসময় শিশুকে শান্ত করেছে। আলাদা জায়গায় বসে থেকে সে অন্য সাথীদের খেলা দেখতে পায় এবং এটা তার নিকট বস্তুপাঠের (Object Lesson) মতাে কাজ করে। সে ধীরে ধীরে অন্য সকলের সঙ্গে মিলেমিশে খেলার সুবিধা উপলব্ধি করতে পারে, সে নিজেই সকলের মধ্যে ফিরে যেয়ে তাদের মতােই খেলাধুলা করতে চায়। এভাবে যেসব শিশু প্রথমে আমাদের  ‍শৃংখলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তাদের সকলেই  ‍শৃংখলার মধ্যে আসতে সক্ষম হয়েছিল। সব সময় আলাদা করে রাখা শিশুর প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়া হতাে, যেন সে অসুস্থ।

আমি নিজে ঘরে ঢুকেই প্রথমে তার কাছে যেতাম, যেন অতি কচি শিশু। তারপর আমি অন্যদের প্রতি মনােযােগ দিতাম, তাদের কাজে কৌতুহল দেখাতাম, তারা যেন ছােট ছােট বয়স্ক ব্যক্তি এভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতাম। যাদেরকে আলাদা করে রেখে শাস্তি দেয়া হতাে তাদের মনে কী ভাব উদয় হতাে, তা বলতে পারি না। কিন্তু তাদের আচরণের পরিবর্তন হতাে স্থায়ী ও সম্পূর্ণ। কেমন করে কাজ করতে হয়, কেমন করে অন্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় এটা শেখে তারা রীতিমতাে গর্ববােধ করতো। তারা অন্যান্য শিক্ষক এবং আমার প্রতি মমতা দেখাতো।”

প্রথমত, এ পদ্ধতির সাফল্য কিছু বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, যা আগের দিনের পুরনাে ধাঁচের স্কুলগুলোতে ছিল না। কোনো রূপ শারীরিক অসুস্থতার জন্য শিশু খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করলে তখন তাকে সরিরে পৃথক করে রাখা হয়। তারপর এ পদ্ধতি প্রয়ােগ করার দক্ষতা ও কৌশলতাে আছেই। কিন্তু মূল্যবান কথা হলাে ক্লাসের বেশিরভাগ ছাত্রের শােভন আচরণ। শিশু যে সব জনমতকে স্বাভাবিকভাবে শ্রদ্ধা করতাে, তখন তারা মনে মনে এর বিরোধিতা করে।

যে স্কুলে শ্রেণীর সকল ছাত্রই হইচই করে শৃংখলা অমান্য করতে উৎসুক, সেখানে শিক্ষককে এক সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। এরকম ক্ষেত্রে আমি শিক্ষকের কি পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত তা আলোচনা করতে চাই না। কেননা প্রথম থেকে শিশুকে উপযুক্ত ভাবে শিক্ষা দিলে শিক্ষকের শ্রেণীকক্ষে এরকম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে না। শিশুরা শিক্ষণীয় বিষয় শিখতে চায়। তবে বিষয়টি শেখার উপযুক্ত হওয়া চাই এবং উপযুক্তভাবে শিক্ষা দেওয়া চাই।