বিশ্বব্যাপী ছড়াচ্ছে পার্কে বই পড়ার উদ্যোগ, পাঠকরা আসছেন বিছানা নিয়ে

বিশ্বব্যাপী ছড়াচ্ছে পার্কে বই পড়ার উদ্যোগ
বিশ্বব্যাপী ছড়াচ্ছে পার্কে বই পড়ার উদ্যোগ  © সংগৃহীত

বই আমাদের জীবনের পরম বন্ধু। জীবনের জন্য, জীবনের সফলতার জন্য এবং মানবসভ্যতার বিকাশের জন্য প্রয়োজন বই। জ্ঞান অর্জন করতে চাইলে নির্ধারিত কোনো বয়স, সময় বা পরিবেশের দরকার হয় না। যখনই সুযোগ হয় জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। ভারতে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে নীরবে বই পড়ার এক অনন্য আন্দোলন। শহরের নির্দিষ্ট কোনো পার্কে সপ্তাহে একদিন বইপত্র নিয়ে হাজির হন মানুষজন। এরপর শুয়ে-বসে বই পড়া শুরু করেন। 

অনেকে সঙ্গে করে বিছানার চাদর, হালকা খাবার, পানি ইত্যাদিও নিয়ে আসেন। এখানে যে যার ইচ্ছামতো পছন্দের বই পড়তে পারে, এমনকি বই না পড়ে ঘুমালেও কেউ কিছু বলবে না। উন্মুক্ত জায়গায় পড়ার এমন বিপ্লবের শুরুটা চলতি বছর জানুয়ারির ৭ তারিখ।

বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন হর্ষ স্নেহাংশু (৩৩) ও শ্রুতি শাহ (৩০)। দুই বন্ধু মিলে উদ্যোগ নিলেন প্রতি সপ্তাহে স্থানীয় পার্কে জমায়েত হয়ে বই পড়ার এক নতুন সংস্কৃতি শুরু করার। ভারতের অন্যতম ব্যস্ত শহর বেঙ্গালুরুর কাবোন পার্কে বই পড়ার উদ্দেশ্যে দুই বন্ধু মিলে খোলেন একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট। নাম দেন 'কাবোন রিডস'। একইরকমভাবে জড়ো হওয়ার স্থানের নামের সাথে রিডস যোগ করে অন্য বড় বড় শহরগুলোর জন্যও খোলা হয়েছে পৃথক পৃথক অ্যাকাউন্ট। 

একমাসের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পান তারা। এখন হর্ষ আর শ্রুতির হাত ধরেই গড়ে উঠেছে পড়ুয়াদের সর্বভারতীয় এক সম্প্রদায়। এমনকি বোস্টন, লন্ডন, প্যারিস ও জোহানেসবার্গেও চালু হয়েছে এমন উদ্যোগ। এগুলোতে যুক্ত হচ্ছেন পরস্পরকে না চেনা হাজারো লোকজন। সবার একটিই পরিচয় — তারা বই পড়তে ভালোবাসেন। প্রতি সপ্তাহে সমুদ্র সৈকত কিংবা পার্কের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশে বই পড়েন তারা। 

লোধি গার্ডেনে বইপড়ুয়ারা। ছবি অভিষেক অনিল

ইনস্টাগ্রামে জানিয়ে দেওয়া সময় অনুযায়ী হাজির হন বই, চাদর ও আনুষঙ্গিক জিনিস নিয়ে। আগত ব্যক্তিরা কী পড়বেন তা নির্ধারিত করা নেই। গল্প, উপন্যাস, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ক্লাসের বই কিংবা গবেষণাপত্র — যে কোনো কিছুই পড়া যাবে। মূলত পড়াকে উৎসাহিত করতেই এমন উদ্যোগ।

সাধারণত ৫–৬ ঘণ্টা সময় নির্ধারণ করেন গ্রুপ কিউরেটরেরা। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে যেকোনো সময় আগ্রহী ব্যক্তিরা আসতে পারবেন আবার যেকোনো সময় চলেও যেতে পারবেন। শেষ আধা ঘণ্টা সাধারণত নির্ধারিত থাকে সদস্যদের নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা ও ছবি তোলার জন্য ।

যেভাবে শুরু
ইনস্টাগ্রামে প্রথমে কাবোন পার্কের একটি গাছের সামনে ধরে রাখা এভরিথিং দ্য লাইট টাচেস বইয়ের ছবি শেয়ার করেন হর্ষ ও শ্রুতি। পোস্টে লেখেনে, 'পুরোনো গাছ নাকি পুরোনো বই! প্রতি শনিবার বই ও ফল নিয়ে গাছটির পাশে আমাদের খুঁজে নিন। নীরব পরিবেশের দরকার হলে আমাদের মেসেজ দিন।'

১৪ জানুয়ারি, প্রথম শনিবারে পার্কে হাজির হন ছয়জন। ইনস্টাগ্রামে একজন মন্তব্য করেন, জ্যাম ঠেলে পার্কে যাওয়া কষ্টকর। দ্বিতীয় সপ্তাহে হর্ষ ও শ্রুতি ছাড়া মাত্র একজন উপস্থিত হন। তখন দুই বন্ধু ভাবেন, বই পড়ার সংস্কৃতি চালু করা উচ্চাভিলাষী কাজ। মানুষের মধ্যে মনে হয় পড়ার আগ্রহ নেই ।

তবে কয়েক সপ্তাহ যেতেই পার্কে আসা লোকজনের সংখ্যা তিন থেকে ৩০ হয়ে যায়। কাবোন রিডসের সাম্প্রতিক এক জমায়েতে ৩০০ জন উপস্থিত হওয়ার উদাহরণও আছে।

হর্ষ স্নেহাংশু বলেন, 'আমি এবং শ্রুতি পড়তে ভালোবাসি এবং প্রায়ই পার্কে বই পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতাম। আমি প্যারিসে ছিলাম, সেখানে দেখতাম সব সময় মানুষের হাতে বই থাকে। আবার সাংহাইতে মানুষ তাদের ডিভাইসের স্ক্রিনে চোখ ডুবিয়ে রাখে। ভাবলাম নিজের ভাবনা শেয়ার করতে পারি সবার সঙ্গে।'

015Book (1)

বর্তমানে ভারতজুড়ে কাবোন রিডসের অনুকরণে প্রায় ৬০টি অ্যাকাউন্ট চালু হয়েছে। কাবোন পার্ক তার ২৫তম সপ্তাহ পূরণ করেছে। অনেক সময় শতাধিক লোক শ্রুতি ও হর্ষের সঙ্গে যোগ দেন।

হর্ষ বলেন, আমি ভেবেছিলাম প্রথম বার্ষিকীতে দশ হাজার লোক পার্কে এসে বই পড়ায় মগ্ন হয়ে গেছে এমন দৃশ্য দেখা হবে দারুণ কিছু। এখন মনে হচ্ছে এটি সহজেই সম্ভব।

নির্দিষ্ট দিনে নারী, পুরুষ, শিশুসহ সব বয়সী মানুষ, এমনকি পুরো পরিবারও অনেক সময় চাদর, বই, পানির বোতল, বিস্কুট, ফলসহ অন্যান্য খাবার নিয়ে হাজির হয়ে যায়। এসে নিজেদের সরঞ্জাম রেখে হয়তো একটি ছবি তোলেন। এরপর ডুবে যান তাদের বইতে।

চেন্নাইয়ের বালুকাময় সৈকত, পুনের কোনো পার্ক, দিল্লির লোধি গার্ডেন কিংবা মুম্বাইয়ের কুঞ্জবনের নিচেসহ নানা পার্ক ও উদ্যানে পড়ুয়াদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। পাঠকদের এসব জমায়েত দেখে মনে হয় যেন কোনো পিকনিক চলছে।

নিঃসঙ্গ মানুষের জন্য আশীর্বাদ
বই পড়ার এই বিপ্লব ভারতীয়দের পার্ক ও উদ্যানের মতো জনসমাগমের স্থান পুনর্দখল প্রচেষ্টার অংশও হয়ে উঠেছে। নয়ডায় যেমন নারীরা রাতে একসাথ হয়ে হাঁটা বা মুম্বাইতে মোটরসাইকেল চালানোর প্রদর্শনীর মাধ্যমেও একই ধরনের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে।

শ্রুতি শাহ বলেন, এখানে বই পড়ার পাশাপাশি অনেকে চিঠি লেখেন, সৃজনশীল লেখালেখি করেন কিংবা নিজেদের গবেষণার কাজ শেষ করেন। যারা মানুষের মাঝে থেকেও নিজেদের পৃথক রাখতে চান তাদের জন্য এটা দারুণ সুযোগ।

শাহ মনে করেন, শহরের উন্মুক্ত জায়গাগুলো পুনর্দখলের ক্ষেত্রে নীরব কার্যক্রম হয়ে উঠছে তাদের উদ্যোগ।

বিহেইভিয়েরাল সাইকোথেরাপিস্ট আয়মান আলি খান বলেন, বই পড়া বেদনা প্রশমনের ওষুধের মতো। এই উদ্যোগ অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষের জন্য দারুণ উপকারী। তারা এখানে যোগদান করে মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পান এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো চাপ থাকে না।

হয়ে উঠেছে অনুপ্রেরণা
মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে শরীরের পুরো বাঁ পাশ অচল হওয়ার আগে অম্বরীশ শিবসুব্রমানিয়ান (৩২) কাবোনে গিয়ে ছবি আঁকতেন। সেখানে তিনি রিডস সদস্যদের দেখতে পেলেন। অম্বরীশ বলেন, 'আমি ভাবলাম, আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দেই না কেন।'

দুই মাস ধরে, প্রতি সপ্তাহে সেখানে ছবি আঁকতে যেতেন অম্বরীশ। স্নেহাংশু ও শ্রুতির সঙ্গে তার বন্ধুত্বও হয়। অস্ত্রপচারের পর অম্বরীশ ইনস্টাগ্রামে চিত্রশিল্পীদের জন্য আলাদা অ্যাকাউন্ট খোলেন। একই দিনে একই সময়ে এবার পড়ুয়া ও আঁকতে পছন্দ করেন এমন মানুষদের আগমন ঘটতে থাকল। কলকাতা, ভাদোদরা এবং মাইসুরেও একইভাবে দুটি গ্রুপ একসাথ হচ্ছে।

৫ থেকে ৭০ বছর — সবাই আসছেন
স্নেহাংশুর বন্ধু রিতিকা চাওলা (৩০) দিল্লিতে চালু করেছেন লোধি রিডস। রিতিকা জানান, আগে এখানে মানুষজন হয়তো ব্যায়াম, হাঁটা কিংবা ইয়োগা করতে আসত, তবে গাছের ছায়ায় বসে বই পড়াটা আরও ভালো কাজ।

তিনি আরও জানান, স্থানীয় কুকরগুলো অনেক সময় তাদের চাদরে এসে আরাম করে। আবার চা ব্যবসায়ীরাও খুঁজে পেয়েছেন ব্যবসার নতুন জায়গা।

মুম্বাইয়ের কাইফি আজমি পার্ক রিডসের কিউরেটর দিয়া সেনগুপ্ত বলেন, 'পৃথক জায়গায় বসে মানুষ একই কাজ করছে, এমন কিছু দেখে অনেকে উৎসাহী হয়। তারা জানতে চায় এখানে কী ঘটছে। আমরা তাদেরকে ব্যাখ্যা করে বলি।'

নীরবে বই পড়তে হলে যা যা মানতে হবে।
তিনি জানান, সম্প্রতি স্ত্রীর সাহায্যে হুইলচেয়ারে বসা এক লোক তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তিনি এখন নিয়মিত মুখ। 

সব বয়সী লোকজন তাদের সঙ্গে পার্কে পড়তে আসছেন। কাবোন পার্কে নিয়মিত আসেন ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। আবার হায়দ্রাবাদের কাসু ব্রাহ্মানন্দ রেড্ডি পার্কে এসে বই নিয়ে বসে রিশিকা (৬) ও সানভি (৫)। নিজের দুই ভাগ্নে ভাগ্নিকে নিয়ে আসা রায়াপ্পা মেকুন্তলা বলেন, 'শিশুরা যা দেখে তা অনুকরণ করে। নিজে মোবাইল চালিয়ে আপনি শিশুদের বই পড়তে বলতে পারেন না। তারা হয়তো খুব কম সময় পড়ায় মন দেয়। তবে বইয়ের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ঠিকই দীর্ঘস্থায়ী হয়।'

অন্যরকম ভ্রাতৃত্বও তৈরি হয়েছে সদস্যদের মধ্যে। সেশনের পর তারা ছবি তোলেন। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করেন। চেন্নাইয়ের বেসি রিডসের সেশন যেমন শেষ হয় মুরুগান ইডলি শপে খাওয়া দাওয়ার মাধ্যমে।

বিপ্লবের শুরু
একই রকম নিয়ম ও লক্ষ্য থাকা পড়ুয়াদের আরও কিছু ক্লাব ও গ্রুপ আছে ভারতে। তবে রিডস ক্লাবগুলোর বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। অন্যান্য ক্লাবে হয়তো অনেক বিধিনিষেধ থাকে। পছন্দ হোক বা না হোক, একই বই পড়তে হয়। বিরক্তিকর হলেও সে বইয়ের আলোচনা হয়তো শুনতে হয়।

কলকাতা রিডসের কো-কিউরেটর দেবমিতা ব্যানার্জি (২০) বলেন, 'তবে আমাদের এখানে এমন নয়। এখানে কোনো চাপ নেই। প্রতি সপ্তাহে আসতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এখানে মানুষ এসে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। আমরা তাদের জায়গা করে দেই।'

চেন্নাইয়ের বেসি রিডসের কো-কিউরেটর ক্রুথিকা কুমার (২৩) বলেন, 'মানুষ যা মন চায়, যেভাবে মন চায় পড়তে পারে। ই-বই পড়ায় বা বইয়ের অডিও শুনতেও কোন বাধা নেই। এমনকি না পড়লেও কোনো আপত্তি নেই। এখানে এসে শুয়ে আকাশে দেখা কিংবা ঘুমানোও যাবে।'

কাবোনে যেমন পড়ার পাশাপাশি অনেকে দাবা খেলেন, কেউ আঁকেন। কিছুদিন আগে এক ছেলে গান বাজানোর যন্ত্র নিয়ে আসে। তবে এখানে নীরবতা বজায় রাখতে হওয়ায় সে হেডফোন ব্যবহার করে ডান্স ক্লাবে ডিজেদের মতো কাণ্ড করতে থাকে।

পড়ার সংস্কৃতির হাত ধরে বাড়ছে বই বিক্রিও। বেঙ্গালুরর বই বিক্রেতা মায়ি গোওদা বলেন, কোভিড লকডাউনের পর বই পড়া লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। বই বিক্রি বেড়েছে ৩০-৪০ শতাংশ। চাহিদার কারণে তিনি আরও একটি দোকান খুলেছেন বলে জানান। তিনি উন্মুক্ত স্থানে পড়ুয়াদের সম্পর্কেও জানেন।

হায়দ্রাবাদে ২০২২ সালে অক্টোবরে চালু হয় লুনা বুক স্টোর। দোকানের মালিক স্বপ্ন সুধাকর বলেন, আমরা খুব বেশি সাড়া পাব বলে আশা করিনি। কিন্তু এখন অনেকে মানুষ আসছেন। বেশিরভাগ ক্রেতা তরুণ-তরুণী। যারা বই পড়া শুরুর আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্রাউজিং করেই কাটাত। 

ভারতে বই প্রকাশের সংখ্যাও বাড়ছে। বাৎসরিক ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে প্রকাশনা। ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতে পড়ুয়াদের সংখ্যা প্রায় ৪৪ কোটি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আর রিডসের মতো সম্প্রদায় এতে আরও বেশি অবদান রাখছে। সম্ভবত এটি বই পড়ার ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনাও।


সর্বশেষ সংবাদ