রপ্তানি না হলেও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে ইলিশ নাগালের বাইরে, দাম কি কমবে?
ইলিশ মাছের দাম বছরজুড়েই অনেক বেশি। সাধারণত এ মাছের দাম অন্যান্য খাদ্যপণ্যের চেয়ে বেশি হয়, কিন্তু এবার নাগালের বাইরেই চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মৌসুম শুরু হলেও দাম কমেনি। কেন এই পরিস্থিতি? এবছর কি আর দাম কমবে?
কারওয়ান বাজারে এখন এক কেজির ইলিশ মাছের দাম ২৫০০-২৬০০ টাকার মতো পড়ছে। বেশি ওজনের মাছ হলে সেটি ওজনভেদে প্রতি কেজি সাড়ে ৩ হাজার টাকায়ও দেখা যাচ্ছে। এক কেজির কম ওজনের মাছের ক্ষেত্রেও কেজিতে ২ হাজার টাকার আশেপাশেই থাকছে। অথচ ভারতে রপ্তানি না হলেও সে দেশে ইলিশের দাম কম।
পলাশী বাজারের একজন বিক্রেতা প্রদীপ রাজবংশী বলছিলেন, এক কেজির ইলিশ গত সপ্তাহেও ২ হাজার টাকায় তারা কিনছিলেন, এ সপ্তাহে ২ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত তারা কিনছেন। ভোক্তা পর্যায়ে গিয়ে দামটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিক্রিও কম হচ্ছে।
চাঁদপুরে যেখানে ইলিশের একরকম ঘাঁটি বলা যায়, সেখানেও এক কেজির মাছ ২ হাজার ৫০০ টাকার আশেপাশে। দেড় কেজির মাছ প্রতি কেজি ৩ হাজার টাকার ওপরে বলছিলেন চাঁদপুর বনিক সমিতির প্রেসিডেন্ট আবদুল বারী জমাদার।
কেন দাম বেশি?
এ বছর দাম বেশি হওয়ার পেছনে মোটাদাগে মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে সরবরাহ কম হওয়া। অর্থাৎ ভরা মৌসুমে প্রত্যাশার তুলনায় কম মাছ পাওয়া যাচ্ছে। পাশের দেশ ভারতেও রপ্তানি হচ্ছে না। আবার সে দেশে স্থানীয় যেসব ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম বাংলাদেশের তুলনায় কম।
আবহাওয়া বেশিরভাগ সময়ে অনুকূলে না থাকায় ‘জেলেরা ইলিশ ধরতে গিয়েও বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন’ বলে জানান মো. আনিছুর রহমান, যিনি ইলিশ গবেষক এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। একের পর এক বিভিন্ন সতর্কতা সংকেত চলছে, তাতে একদিকে যেমন জেলেদের মাছ ধরতে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, অন্যদিকে ধরতে গেলেও সহজে সেভাবে মাছ ধরা যাচ্ছে না। ‘এর মানে তো এই না ইলিশ নেই, কিন্তু ইলিশ আহরণে বাধা তৈরি হচ্ছে, যোগ করেন তিনি।
অবশ্য বড় পরিসরে আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যেসব কারণে ইলিশের স্বাভাবিক বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর মাঝে একটি নদীতে অনেক জায়গাতেই নাব্য কমে যাওয়া। বিশেষত দক্ষিণাঞ্চলে সাগর থেকে নদীতে যে পথ ধরে ডিম ছাড়ার জন্য ইলিশ আসে, সেখানে অনেক জায়গাতে পলি পড়ে ডুবোচর তৈরি হয়েছে। যেখানে ইলিশ অনেকটা গভীর পানিতে চলাচল করে সেখানে নাব্য সমস্যা স্বাভাবিক গতিপথকে বাধাগ্রস্ত করে।
এ নাব্যতার সমস্যা শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয়, দেশজুড়েই নদ-নদীতে প্রভাব ফেলেছে। ফলে ইলিশের বিচরণের পাশাপাশি নৌযান চলাচলেও ব্যাঘাতের কারণ হয়। এছাড়াও রয়েছে দূষণের মতো সমস্যা, যার কারণে খাবার ও বিস্তারের জন্য পরিবেশ অনেক দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সমস্যাগুলো অবশ্য নতুন নয়। চাঁদপুর বনিক সমিতির সভাপতি আবদুল বারী জমাদার ২০০৫ সালে ইলিশ ব্যবসায় আসেন, সেসময় থেকেই প্রজননক্ষেত্র ঠিক করতে নদীতে ড্রেজিং হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা শুনে আসছেন। এ ছাড়া নদী ও সমুদ্রে যখন মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলে, তখনও অনেক দিক দিয়ে মাছ ধরা হয়। জাটকা বা মা মাছ নিধনের পাশাপাশি আছে কারেন্ট জাল ব্যবহারের মতো সমস্যাও।
এ ছাড়া মাছের বাজারের উচ্চ দামের জন্য অনেকে সিন্ডিকেটের অভিযোগও তুলে থাকেন। ব্যবসায়ীরা তা অস্বীকার করেন। তবে ২০২২ সাল হতে ২০২৩ সালের দিক থেকেই নদী ও সমুদ্র দুই দিকেই ইলিশ কম পাওয়া যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করছেন বলে জানান আবদুল বারী জমাদার। মৎস্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেখানে পাঁচ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ হয়েছিল, সেটা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিক টন হয়।
অথচ এর চাহিদা কমেনি, বরং বাজারের পাশাপাশি এখন অনলাইনেও বিক্রি হয়। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়া দাম বাড়ার একটা কারণ। একদিকে এমন নানাবিধ সমস্যা একই সাথে সামগ্রিক জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছ আহরণ করতে যাওয়াটাও আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হচ্ছে। বড় ট্রলারগুলোতে করে মাছ ধরতে ২০০৫ সালে লাগতো ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা। এখন লাগে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা।
দাম কি এবছর কমবেই না?
নানা সমস্যা থাকলেও ইলিশের দাম কমার এখনও সুযোগ আছে। এখন ইলিশের মৌসুম শুরু হলেও সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাস মূল মৌসুম বলে উল্লেখ করেন গবেষক মো. আনিছুর রহমান। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে পূর্ণিমার সময় সুযোগ রয়েছে, যখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বেশি মাছ ধরা সম্ভব হতে পারে।
আরও পড়ুন: প্রাথমিক শিক্ষকদের মহাসমাবেশ নিয়ে ‘জটিলতা’ কেটেছে, জড়ো হচ্ছেন শহীদ মিনারে
তিনি বলেন, ‘ধরার পরিবেশ হলেই তখন দেখা যাবে একেকটা জালে আগে যে পরিমাণ মাছ হতো তার দ্বিগুন-তিনগুন পরিমাণে মাছ পাচ্ছে। যদি সরবরাহ বাড়ে দুই দিন থেকে সর্বোচ্চ তিন দিন লাগে দাম কমতে। সেটা দেখা যায় কেজিপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত কমে যায়।
সেপ্টেম্বর মাসে ইলিশ আরও পাওয়া যাওয়ার আশাবাদ জানাচ্ছেন মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক ময়েদুজ্জামানও। ‘সেক্ষেত্রে দাম আশা করছি যদি ভালো ক্যাচ হয় তাহলে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত (এক কেজির) আমরা হয়তো ঘাটে পেতে পারি। এ পর্যন্ত আমরা সর্বনিম্ন ২ হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত পেয়েছি (বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনায় ঘাটে এক কেজির মাছ)। আরেকটু ভালো যদি ধরা যায়, তাহলে দামটা হয়তো আরেকটু কমবে’, ধারণা দেন তিনি।
সমস্যাগুলোর সমাধান কি হবে?
যেসব সমস্যার কারণে সার্বিকভাবে মাছের বিস্তার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেগুলোর সমাধান করা অতটা সহজ নয়। যেমন জলবায়ু সংকটে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বা দূষণের মতো দিকগুলো ঠিক করতে যতটা সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন, সে জায়গার ঘাটতি রয়েছে। যে সময়টাতে মাছ ধরা বন্ধ থাকার কথা, সেসময় নিয়মিত অভিযান চালানো হলেও অনেক সময়েই একটু দুর্গম অঞ্চলে সব দিক দিয়ে নজরদারি সম্ভব হয়ে ওঠে না, সেটা স্বীকার করেন ময়েদুজ্জামান।
নাব্যতার ব্যপারে তিনি বলছেন, যেসব জায়গায় নাব্য সমস্যা দেখা গেছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে ম্যাপিং করা হয়েছে। পরবর্তীতে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং ড্রেজিং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাদের দিক থেকে যে ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, সে অনুযায়ী যদি কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ইলিশের হ্যাবিটেট ফিরে আসা সম্ভব হতে পারে বলে আশা তার। বিবিসি বাংলা।