একদিনেই সাত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, দিশেহারা কয়েক লাখ ভর্তিচ্ছু
- ফরহাদ কাদের
- প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:৪২ AM , আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ১১:১৪ AM
ফের বিপাকে পড়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিচ্ছুরা। আগামী ৯ নভেম্বর একযোগে সাতটি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হওয়ায় ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারছেন না কয়েক লাখ শিক্ষার্থী। যা শুধু ভর্তিচ্ছু-অভিভাবকদেরই নয়, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছে। ঘোষিত তারিখ পরিবর্তন করে পরীক্ষার নতুন তারিখ দেয়া যায় কিনা— সে বিষয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে দাবি তুলেছেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী বছর থেকে সমন্বিত বা গুচ্ছভর্তি পরীক্ষা চালু হওয়ার সম্ভাবনা আছে; সেটি চালু না হলে এই সমস্যা দূর হবে না। তাদের ভাষ্য, একইদিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত হলে শুধু যাতায়াতেই সমস্যা হয় না; শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপও বাড়ে। পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীদের সুবিধা মতো তারিখ নির্ধারণ করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানান তারা।
জানা যায়, আগামী মাসের ৯ এবং ১০ তারিখ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ডেন্টাল কলেজ, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ঢাকার ৭ কলেজের ভর্তিপরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন কয়েক লাখ পরীক্ষার্থী; যাদের অধিকাংশই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি বিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ এবং ‘বি’ ইউনিটের পরীক্ষা হবে ৯ নভেম্বর। আর ‘সি’ ইউনিটের হবে ১০ নভেম্বর। এর মধ্যে ‘এ’ ইউনিট বিজ্ঞান অনুষদের জন্য। একই দিন বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ইউনিটের পরীক্ষা রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘সি’ এবং ‘এইচ’ ইউনিটের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে এদিন। যা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য। আবার বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, ডেন্টাল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ৭ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষাও এদিন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া পরের দিন অর্থাৎ ১০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘আই’ ইউনিটের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। একই দিন পরীক্ষা রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট।
তথ্যমতে, বর্তমানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে শিক্ষার্থীদের দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটতে হয়। এমনও হয়েছে, সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে না পারায় অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এমনকি সকালে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে বিকালে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশ নেয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। টানা দুই-তিন মাস ধরে শিক্ষার্থীদের এমন ভর্তিযুদ্ধে এক দুঃসহ লড়াইয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকছেন তাদের অভিভাবকরা।
অভিভাবকরা বলছেন, আমাদের সন্তানরা মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে না পারলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে। কিন্তু একদিনে এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেলে ডেন্টালের সুযোগ হারাবে, আবার ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও পড়ার সুযোগ হারাবে। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
আর শিক্ষার্থীরা জানান, কোনটা রেখে কোনটার পরীক্ষা দিব? বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছেন শাহাদাৎ হোসাইন নামের এক পরীক্ষার্থী। তিনি বলেন, চোখে অন্ধকার দেখছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। তার মত অনেক শিক্ষার্থীই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন বলে জানান শাহাদাৎ।’ রহমত উল্লাহ নামের এক পরীক্ষার্থী বলেন, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাবি অধিভুক্ত ৭ কলেজে আবেদন করেছি। এখন কোথায় পরীক্ষা দিব সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন বলেন, দেশে এখন অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওভারলেপ হচ্ছে। কারণ, অনেকগুলো ইউনিট থাকে। স্বভাবতই পরীক্ষা নিতে সময় লাগে। তিনি বলেন, অনেক বিষয় চিন্তা করে পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে, চাইলেও তা পরিবর্তন করা যাবে না।
সমস্যা চবি, নোবিপ্রবি ও বশেমুরপ্রবি ঘিরেও
বিপাকে পড়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরপ্রবি) ভর্তিচ্ছুরাও। জানা যায়, আগামী ২৬, ২৭ এবং ২৮ অক্টোবর নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আর ২৭, ২৮, ২৯ এবং ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২৮, ২৯ অক্টোবর ও ২, ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সূচি নির্ধারিত হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলোতে আবেদন করতে পারেননি। কারণ, তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট চারদিনের মধ্যে দুই দিনের পরীক্ষাই একই সময়ে। তাছাড়া পথের দূরত্বের কারণেও শিক্ষার্থীদের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়।
বারবারই ভেস্তে যায় সমন্বিত পরীক্ষার উদ্যোগ
খোঁজে জানা যায়, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ কমাতে এ পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৯ সালে। কিন্তু কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আপত্তি এবং আঞ্চলিক শিক্ষার্থীদের বিরোধিতার মুখে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে বাস্তবায়ন হয়নি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। তবে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত আছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অনেক আগে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির অধীনে কুয়েট, চুয়েট ও রুয়েটে (সে সময় যথাক্রমে বিআইটি খুলনা, বিআইটি চট্টগ্রাম ও বিআইটি রাজশাহী নামে এগুলো পরিচিত ছিল) একযোগে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হতো। ২০১৩ সালে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার উদ্যোগ নেয়। তখন বলা হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামতো যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিতে পারবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। শেষ অবধি তা হয়নি। কিছু সংগঠন ও বিশেষ করে সিলেটে স্থানীয়দের বিরোধিতার কারণে ভেস্তে যায় এ শুভ উদ্যোগ। এবার কোনোভাবেই সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেয়া যাবে না।
সার্বিক বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ায় অনেক সমস্যা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিযুদ্ধের সময় ভোগান্তি এড়াতে রাষ্ট্রপতি বার বার তাগাদা দিয়ে আসছিলেন। এর প্রেক্ষিতেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো বৈঠক হয়েছে। ইউজিসি চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, একটি কমিটিও করা হয়েছে। তিনি বলেন, এক ধরনের ওপেনিয়ন চলে এসেছে। আগামী বছর থেকেই গুচ্ছ বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন