ইবি-জবির সিদ্ধান্তহীনতায় পেছাচ্ছে গুচ্ছের সার্কুলার

গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়
গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

এবারও ২২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। গত মাসে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি মার্চ মাসের শেষ দিকে গুচ্ছের অধীনে ভর্তি পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি (সার্কুলার) প্রকাশ করার কথা ছিল। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শিক্ষক সমিতি গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তের ঘোষণায় ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম থেমে রয়েছে।

এদিকে, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) এক সভা থেকে জবি ও ইবিকে গুচ্ছে থাকতে হবে জানানোর পর নতুন করে আলোচনায় আসে সময়মতো এবছর গুচ্ছের সার্কুলার প্রকাশের বিষয়টি। তবে গুচ্ছ ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এবছর ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করার জন্য এখনো কোন কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে চলতি মার্চ মাসে গুচ্ছের সার্কুলার প্রকাশের সম্ভাবনা নেই।

তথ্যমতে, গত ফেব্রুয়ারিতে এক সভায় গুচ্ছ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা এবং শিক্ষকদের নানা অসন্তোষের বিষয়গুলো আমলে নিয়ে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে এবং গুচ্ছের চলমান নানা সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি অব্যাহত রেখে গুচ্ছের অধীনে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অব্যাহত রাখার এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর থাকা-না থাকার টানাপোড়নে আবারও একটি অনিশ্চিত গন্তব্যে এগোচ্ছে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগটি। 

গত মাসের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের আগামী জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্লাস শুরুর পরিকল্পনা করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য মার্চের শেষ দিকে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া এপ্রিলের শেষ দিকে অথবা মে মাসের শুরুর দিকে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছিল।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন, আগামী ২৯ মার্চ আমরা সাধারণ সভা ডেকেছি; সেখানে শিক্ষক সমিতি যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে-তা আমরা জনিয়ে দেব। সভায় গুচ্ছের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, গুচ্ছের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারার কারণে অনিশ্চয়তায় রয়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। তাদের দায়ভার কে নিবে— এমন জিজ্ঞাসাও তার।

তবে, এখনো নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকার কথা জানিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোদ্দার বলেন, আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছি; আপাতত তা থেকে সরে আসার কোন সুযোগ নেই। আমরা একাডেমিক কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সিদ্ধান্ত বদলাতে হলে একাডেমিক কাউন্সিলেই তা নিতে হবে--আপাতত একাডেমিক কাউন্সিলে বসার কোন পরিকল্পনা নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।

ইবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, আমাদের শিক্ষকরা ইতোমধ্যে একটি সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন, এখন আমার তাদের বোঝানো ছাড়া খুব বেশি কিছু করার নেই। আমি তাদের সাথে কথা বলবো, তখন আমরা দেখবো নতুন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারি কি-না। শিক্ষকদের বাদ দিয়ে বা তাদের ছাড়া উপাচার্য চাইলেও কিছু করতে পারবে না, এটা শুধুমাত্র এখানে না, সবখানেই— দেখা যাক কি হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক বলেন, সামনে আমাদের সিন্ডিকেটের সভা রয়েছে; সভার পর সিদ্ধান্ত জানানো হবে। 

এর আগেও গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে যেতে বেশ কয়েক দফা দাবি জানানোর পর জবি শিক্ষক সমিতি চলতি মাসে গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা জানায়। জবির পর একই সিদ্ধান্ত জানায় ইবি শিক্ষক সমিতি। এছাড়াও গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যেতে আগ্রহী গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষক সমিতিও।

ফেব্রুয়ারির সভায় শিক্ষামন্ত্রী আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ সেশন থেকে একটি গুচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তাব করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ করতে এ আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গেল দুই বছরের ভর্তি পরীক্ষায় দীর্ঘসূত্রিতা, ভর্তিতে কালক্ষেপণ, উপাচার্যদের সিদ্ধান্তহীনতা, ভর্তিতে নানা জটিলতা ও হয়রানিসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়াও গুচ্ছে না থাকার দাবি জানানোর বিষয়ে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদেরই গুচ্ছে থাকতে অনীহার কারণগুলোও এদিন শিক্ষামন্ত্রীকে জানিয়েছেন সভায় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিরা। 

তবে শিক্ষামন্ত্রী চাচ্ছেন, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তিনি একটি ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা চান। প্রয়োজনে স্যাট (একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য কতখানি তৈরি, তা এ পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয়ে থাকে)–এর মতো ব্যবস্থা তার সমাধান হতে পারে বলেও ইঙ্গিত করেন তিনি। 

শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে একটি পরীক্ষা হয়। সেখানে হয়তো গণিত, বিজ্ঞান বা ভাষা—এ জাতীয় বিষয় এবং সাধারণ জ্ঞানের ওপর পরীক্ষা হয়। সেই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে যারা এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষা দিচ্ছে, তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবারও একই বিষয়ের ওপর পরীক্ষা দিচ্ছে। সেটি না করে ভাষা, গণিত, সাধারণ জ্ঞানের ওপর একটি পরীক্ষা হওয়া উচিত। আর যতক্ষণ না পর্যন্ত সেটিতে যেতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বিদ্যমান গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষা ব্যবস্থাপনাকে আরও ভালো করতে হবে।

ডা. দীপু মনি মনে করেন, গুচ্ছ পদ্ধতিতে যেতে যত সময় লেগেছে, নতুন পদ্ধতিতে যেতে তত সময় লাগবে না। তিনি জানান, উপাচার্যদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সঙ্গে কথা বলে যে ধরনের মতামত পাওয়া গেছে তাতে মনে হয়, হয়তো অনেক কম সময়েই নতুন পদ্ধতিতে যাওয়া যাবে।

এর আগে গত বছরও শিক্ষামন্ত্রী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়ে বলেছিলেন, আমরা প্রথমবারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছি। কিছু ভুলত্রুটি থাকবেই। শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ভুলত্রুটি সংশোধনের মাধ্যমে গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে বের না হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য সার্বিক ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ করতে ২০২০-২০২১ সেশন থেকে শুরু হয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। স্বায়ত্তশাসিত ও বিশেষায়িত ছাড়া প্রথমবার ২০ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শুরু হরেও পরের বছর থেকে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে শুরু হয় এ ভর্তি প্রক্রিয়া। এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য বিবেচনায় যতটুকু ইতিবাচক আশার সঞ্চার করার কথা ছিল দুই সেশনে ভর্তি কার্যক্রম চালিয়ে তার চেয়েও বেশি হতাশার সৃষ্টি করায় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথাও আসে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতি থেকে। 

শিক্ষক সমিতিগুলোর সদস্যরা বলছেন, ভর্তিতে দীর্ঘ-সময়ক্ষেপণ, শিক্ষার্থীদের হয়রানি, সেশনজট, ফলাফল সংক্রান্ত জটিলতা এবং গুচ্ছ নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকাসহ বিবিধ নেতিবাচক বিষয়ের সমাধান হওয়া দরকার। পাশাপাশি তারা মনে করেন, গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়াটি আরও পরিকল্পিত হওয়া উচিৎ। সেজন্য চলমান কৃষি গুচ্ছের মতো করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আলাদা ভর্তি প্রক্রিয়া বা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও জানান তারা। শিক্ষার্থীদের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে বিষয় প্রদানের পাশাপাশি গুচ্ছের চলমান অব্যবস্থাপনার সমাধান চান শিক্ষকরা।

প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে ৫৩টি সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সবগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাবি, রাবি, চবি ও জাবি এবং কয়েকটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অধিকাংশই গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যাতে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন শিক্ষার্থী একটি পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হতে পারেন। আর ১৯৭৩ সালের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ থাকে আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে।


সর্বশেষ সংবাদ