পটুয়াখালী জেলা মুক্তির ইতিহাস

গ্রাফিক্স ছবি
গ্রাফিক্স ছবি  © সংগৃহীত

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর একমাস পর ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত পটুয়াখালী ছিল পাকিস্তানী মুক্ত। ২৬ এপ্রিল হানাদার কবলিত হয়। দীর্ঘ ৮মাস পাক-হানাদারদের হাতে অবরুদ্ধ থাকার পর একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত হয় এই জেলা। এইদিনে একদিকে স্বজন হারানোর বিয়োগ ব্যথার দীর্ঘশ্বাস, অন্যদিকে মুক্তির আনন্দে উদ্বেল ও সৃষ্টি সুখের উল্লাস। হৃদয় উজাড় করে বরণ করে নেয় পটুয়াখালীবাসী হানাদার মুক্ত এই দিনটিকে। একাত্তরের ২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষনা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

২৬ এপ্রিল’৭১ পটুয়াখালী পাক-হানাদার কবলিত হয়। এর একমাস আগে পটুয়াখালী জেলা নিয়ন্ত্রিত হয় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট কাজী আবুল কাসেম ও সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী খানের নেতৃত্বে তৎকালীন গঠিত জেলা সংগ্রাম পরিষদের তত্ত্বাবধানে। সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয় বর্তমান সরকারী মহিলা কলেজে। সরকারী জুবিলী স্কুল মাঠে একমাস ধরে চলে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। ২৬ এপ্রিল’৭১, সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা। পাক-হানাদারদের জঙ্গি বিমান ছুটে আসে পটুয়াখালীর আকাশে। শুরু হয় বিমান হামলা। চলে শেলিং আর বেপরোয়া গোলাবর্ষণ।একনাগাড়ে কয়েকঘন্টা বোমা হামলা চালিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে কালিকাপুর এলাকায় অবতরণ করে পাকিস্তানী সেনারা। উন্মত্ত আক্রোশে হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র জনতার উপর।

মারণাস্ত্রের ভয়ঙ্কর শব্দ, আক্রান্ত মানুষের আর্তনাদ, লুণ্ঠন, অগ্নি-সংযোগ সবমিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক নারকীয় পরিস্থিতির। অগ্নি-সংযোগে ভস্মীভূত করা হয় শহরের বাণিজ্যিক সমগ্র পুরান বাজার এলাকা। যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে মুক্তিকামী জনতার লাশ। পাকসেনারা গুলিবিদ্ধ করে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ আবদুল আউয়ালকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে রাইফেল তুলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা। সেনারা অবতরনকালে কালিকাপুর মাতবর বাড়ির শহীদ হয় ১৭ জন, প্রতিরোধ করতে গিয়ে জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে শহীদ হন ৬ জন আনসারসহ ৭ জন। এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে ও জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যা করা হয় বহু লোককে।

এদের অধিকাংশকেই দাফন করা হয় বিনা জানাজায় গণকবরে। মাতবর বাড়ি, জেলা প্রশাসকের বাসভবনের অদূরে আনসারদের ও পুরাতন জেলখানার অভ্যন্তরে গণকবর আজো মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার নির্মম সাক্ষী বহন করে। একাত্তরের দীর্ঘ ৮ মাস ধরে চলে জেলার বিভিন্ন এলাকা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার পালা। অভ্যন্তরে সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধা দলের গেরিলা যুদ্ধের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। পাক-হানাদাররা ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে সদর উপজেলার মাদার-বুনিয়া গ্রামে শাহজাহান ফারুকের নেতৃত্বাধীন দলের নিকট পটুয়াখালী জেলার প্রথম মুখোমুখি প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এরপর সাব-সেক্টরের অধীন ইউনিট প্রধানগণ দলবল নিয়ে জেলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করে। বাউফলের কালিশুরী যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ইউনিট প্রধান হাবিলদার পঞ্চম আলী। পটুয়াখালী জেলায় সবচেয়ে বড় সম্মুখ যুদ্ধ হয় ১৮ নভেম্বর গলাচিপা উপজেলার পান পট্টিতে। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা ও হাবিবুর রহমান শওকতের নেতৃত্বে পান পট্টির এই যুদ্ধে পটুয়াখালীতে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয় সূচীত হয়।

পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা কলাপাড়া,গলাচিপা, বাউফল, আমতলী, মির্জাগঞ্জসহ এই সাব-সেক্টরের আওতায় সকল থানা দখল করে নেয়। প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পটুয়াখালীর দায়িত্বে নিয়োজিত পাকজান্তা মেজর ইয়ামিন তার সেনা সদস্যদেরকে নভেম্বরের শেষ দিকে সকল থানা থেকে প্রত্যাহার করে পটুয়াখালী জেলা সদরে নিয়ে আসে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা সুসংগঠিত হতে থাকে পটুয়াখালী আক্রমণের জন্য। সর্বত্র গুজব ছড়িয়ে পড়ে ১০ডিসেম্বর রাতে মুক্তি বাহিনী পটুয়াখালী দখলে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ইউনিট সংগঠিত হচ্ছে। এতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে পাক-হানাদাররা।

৭ ডিসেম্বর রাতে পটুয়াখালী শহরে কারফিউ জারী করে দোতালা লঞ্চ যোগে পলায়ন করে পাকসেনা ও তাদের কতিপয় বিশ্বস্ত দোসর। ৮ ডিসেম্বর’৭১, সকাল সড়ে ১০টা। মিত্রবাহিনী পটুয়াখালীতে বিমান আক্রমণ চালিয়ে লাউকাঠী খাদ্য গুদাম ঘাটে পাকিস্তানী পতাকাবাহী খাদ্য বোঝাই একটি কার্গো শেল নিক্ষেপে ডুবিয়ে দেয়। পাক-হানাদারদের সহযোগী রাজাকার-আলবদররা অস্ত্র ফেলে পালাতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা বিনা বাঁধায় প্রবেশ করে পটুয়াখালীতে। স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে মুক্তিযোদ্ধারা পটুয়াখালীর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে।


সর্বশেষ সংবাদ