১৬ অক্টোবর ২০২৫, ২২:১১

এইচএসসির ফলাফলে ধস, দায় শিক্ষার্থী নাকি শিক্ষাব্যবস্থার

এবারের এইচএসসির ফলাফলে বড় ধসের দায় শিক্ষার্থী নাকি শিক্ষাব্যবস্থার  © সংগৃহীত

উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম পাসের হারে এবার রেকর্ড হয়েছে। ২০০৫ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৫৯.১৬ শতাংশ; এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই হার বেড়েছে বা সামান্য কমবেশি হয়েছে। কিন্তু এবারের ফলাফল শিক্ষার্থীদের জন্য যেন এক বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। পাসের কম হার ও ফল ধসের দায় শিক্ষার্থী নাকি শিক্ষাব্যবস্থার?

২০২৫ সালে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে গড় পাসের হার হয়েছে মাত্র ৫৭.১২ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ এ বছর প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাসই করতে পারেননি। শুধু পাসের হার নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২৪ সালে ১ লাখ ৩১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন; ২০২৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৮ হাজার ৫২১ জন। তবে এবারে তা কমে এসেছে মাত্র ৬৩ হাজার ২১৯ জনে।

আরও পড়ুন: জিপিএ-৫ পেলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন না ১৯ হাজার শিক্ষার্থী

দুই দশকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫–২০০৮ সালের মধ্যে পাসের হার ক্রমে বেড়ে প্রায় ৭৫ শতাংশে পৌঁছেছিল। তবে ২০০৯ সালে তা কিছুটা হ্রাস পেয়ে ৭০.৪৩ শতাংশে নেমেছিল। ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৮ সালেও পাসের হার ৭০ শতাংশের নিচে নেমেছিল। ২০২০ সালে অতিমারি করোনার কারণে পরীক্ষা বাতিল, এবং ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ সবাই উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০২১ ও ২০২২ সালে পাসের হার আবারও ৮৪–৯৫ শতাংশের মধ্যে ওঠে। ২০২৩ সালে তা ৮০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। আর এবার পাসের গড় হার ৫৭ শতাংশে পৌঁছেছে—দুই দশকের মধ্যে যা সর্বনিম্ন।

শুধু পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে তা-ই নয়, এ বছর শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমে ১,৩৮৮ থেকে ৩৪৫-এ নেমেছে। আবার, শূন্য পাসের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ থেকে ২০২-এ।

ফলাফল ধসের দায় কার

টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে পরীক্ষার ফলাফল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রকাশের অভিযোগ ছিল আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সে পথে হাঁটেনি বলেই ফলাফলে কিছুটা ধস নেমেছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক রত্না সাহা বলেন, ‘এবার নির্দেশ ছিল-শিক্ষার্থীরা যেমন লিখবে, সে অনুযায়ী নম্বর দেওয়ার। এ কারণেই হয়তো ফল খারাপ হয়েছে।' এই স্কুলের আরেক শিক্ষক জানান, অন্যবারে সহনীয় মাত্রায় খাতা দেখার জন্য বলা হতো। এবার তা হয়নি বলেই ফল হয়তো কিছুটা খারাপ হয়েছে। 

শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন শিক্ষার্থীদের নানা সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে বলেই ফল খারাপ হয়েছে।

ফলফল ধসের কারণ হিসেবে বারবার শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ও দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতিকে দায়ী করে কুমিল্লার হোমনা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তবারক উল্লাহ বলেন, ‘পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ও খাতা দেখার ক্ষেত্রে বাড়তি কড়াকড়ি আরোপের প্রভাবও এবারের ফলাফলে পড়েছে।’

আরও পড়ুন: শীর্ষে নটর ডেম-আদমজী, জিপিএ-৫ ও পাসের হারে এগিয়ে যে ১০ কলেজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন এ বিষয়ে বলেন, ‘প্রথমত, বাচ্চারা পরীক্ষা দিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর। তাদের অনেকেই এক ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা থাকারও একটা প্রভাব আছে। স্কুল বন্ধ ছিল। পড়াশোনা ঠিকমতো হয়নি।'

তিনি আরও বলেন, ‘এতোদিন যে ফলাফল দেখানো হয়েছে সেটি ছিল রাজনৈতিক। এবারের ফলাফল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র অনেকাংশে তুলে ধরেছে বলেই মনে করি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যা অনেক সময় শিক্ষাবান্ধব হয়েছে কখনো বা রাজনীতিবান্ধব। রাজনৈতিক ইচ্ছায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করার প্রবণতা আমরা দেখেছি যা শিক্ষার্থীদের নিজেদের যোগ্যতায় ভালো ফল করার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে।’

আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ‘আমরা কাউকে কোনো ছক বেঁধে দিইনি বা বেশি নম্বর দিয়ে পাসও বাড়াতে বলিনি। এই যে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস করতে পারেননি, এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। তবে এতে শিক্ষার্থীর দোষ নেই—গলদ আছে, এবং সেই গলদ ঠিক করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এমন বাস্তবতা আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। আমরা সেটা ফ্যাব্রিকেট (বানানো) করিনি। এ ফলাফল খারাপের পাশাপাশি এটিকে রিয়ালও (বাস্তব) বলা যায়। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ব্যাপারে অনেকটা বিমুখ, টেবিল থেকে দূরে ছিলো বলে আমরা ধারণা করছি। সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের পরবর্তী দায়িত্ব এর কারণ অনুসন্ধান করা।’

আরও পড়ুন: বদলে গেল এইচএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের নিয়ম, আবেদন শুরু কাল 

শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরারও স্বীকার করেছেন, “বাংলাদেশে শেখার সংকট শুরু হয় প্রাথমিক স্তর থেকেই। কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চাইনি। সংখ্যাকে সত্য ধরে রেখেছিলাম—পাসের হার ও জিপিএ-৫-এর সংখ্যা ছিল সাফল্যের মানদণ্ড। ফলাফল ‘ভালো’ দেখাতে গিয়ে আমরা শেখার প্রকৃত সংকট আড়াল করেছি।”

গত পনেরো বছরের জিপিএ-৫ পরিসংখ্যানও বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে। ২০০৯ সালে মাত্র ২০ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। ২০২০ সালের মহামারির বছরে কোনো পরীক্ষা হয়নি, অথচ রেকর্ড ১ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। পরের বছরগুলোয় এ সংখ্যা আরও বেড়ে ১ লাখ ৮৯ হাজার (২০২১) ও ১ লাখ ৭৬ হাজার (২০২২) হয়। ২০২৪ সালে ‘অটো পাস’-এর বছরেও তা ১ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি হয়। কিন্তু ২০২৫ সালে জিপিএ-৫ ও পাসের হারে হঠাৎ ধস নামে। ধসের মুখে পড়া শিক্ষার্থীরা এর জন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়।

বিশিষ্টজনেরা বলেন, শিক্ষার্থীদের ভিকটিমাইজ করা বা অতিরিক্ত স্ক্রুটিনি (Scrutiny) চালানো অনুচিত। তারা ব্যর্থ নয়। এর দায়ও শিক্ষার্থীদের নয়। তাদের শিক্ষা ও শেখার সুযোগ দিতে হবে। ফলাফল ধসের দায় শিক্ষাব্যবস্থা, নীতিনির্ধারক, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি রাষ্ট্রের। এখান থেকে অবশ্যই উত্তরণ করতে হবে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আরও ভূমিকা রাখতে হবে।