১৬ অক্টোবর ২০২৫, ২০:৩৩

দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পাসের হার, শিক্ষার মান কমল নাকি বাড়ল?

এবারের ফলাফলে শিক্ষার্থীদের জন্য যেন এক বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে  © টিডিসি ফটো

২০২৫ সালের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর)। এবারের ফলাফল বিশেষভাবে নজর কাড়ছে, কারণ দুই দশকের মধ্যে এটি সবচেয়ে কম পাসের হার রেকর্ড করেছে। ২০০৫ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৫৯.১৬ শতাংশ; এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই হার বেড়েছে বা সামান্য কমবেশি হয়েছে। কিন্তু এবারের ফলাফলে শিক্ষার্থীদের জন্য যেন এক বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। পাসের হার কমে যাওয়ায় অনেকে ভাবছেন, শিক্ষার মান কি কমল নাকি বাড়ল?

২০২৫ সালে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে গড় পাসের হার হয়েছে মাত্র ৫৭.১২ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ এই বছর প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করতে পারেননি। শুধু পাসের হার নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২৪ সালে ১ লাখ ৩১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন; ২০২৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৮ হাজার ৫২১ জন। তবে এবারে তা কমে এসেছে মাত্র ৬৩ হাজার ২১৯ জনে।

আরও পড়ুন: জিপিএ-৫ পেলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন না ১৯ হাজার শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে এবারের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৪২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছেন ৫ লাখ ৯৮ হাজার ১৬৬ জন। পাশাপাশি মাদ্রাসার আলিম এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ভোকেশনাল, বিএম ও ডিপ্লোমা ইন কর্মাস পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) জানায়, ২০০৫ সালের পর থেকে এইচএসসির পাসের হার ধারাবাহিকভাবে ওঠানামা করেছে। ২০০৬ সালে পাসের হার বেড়ে প্রায় ৬৪ শতাংশ, ২০০৭-এ ৬৪ শতাংশের বেশি, ২০০৮-এ প্রায় ৭৫ শতাংশ। ২০০৯ সালে তা কমে গিয়ে ৭০.৪৩ শতাংশে দাঁড়ায়। পরবর্তী বছরগুলোয় পাসের হার সাধারণত ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। মাত্র তিন বছর (২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৮) ৭০ শতাংশের নিচে নেমেছিল।

২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সরাসরি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। সেক্ষেত্রে ‘বিশেষ প্রক্রিয়া’ অনুযায়ী সবাই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ২০২১ ও ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় পাসের হার যথাক্রমে ৮৪ শতাংশের বেশি এবং ৯৫ শতাংশের বেশি ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে তা আবার ৮০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। এবার ২০২৫ সালে পৌঁছেছে মাত্র ৫৭ শতাংশে, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

আরও পড়ুন: শীর্ষে নটর ডেম-আদমজী, জিপিএ-৫ ও পাসের হারে এগিয়ে যে ১০ কলেজ

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ইংরেজি, গণিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছেন। এই বিষয়গুলোর ফলাফলের প্রভাব সার্বিক ফলাফলের ওপর পরিলক্ষিত হয়েছে। 

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় যতটুকু বা যেরকম লিখেছে, মূল্যালয়ের পর সেটিই প্রতিফলিত হয়েছে গড় রেজাল্টে। এখানে বোর্ড থেকে বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নিদের্শনা ছিল না। যার ফলে এবারের ফলাফলে আরোপিত কিছু নেই।

শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা বলছেন, অতীতে বেশি নম্বর দিয়ে ভালো ফলাফল দেখানোর চেষ্টা কিংবা এখন সঠিক মূল্যায়নের দাবি করে ফলাফল খারাপ যেটিই হোক না কেন, এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা যা শেখার কথা সেটি তারা কি শিখছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলছেন, ‘ফলাফল খারাপ বা ভালো হওয়ার পেছনে কেবল রাজনৈতিক কারণ খুঁজলেই হবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া কতটা হচ্ছে, শিক্ষকরা আসলে ক্লাসে পড়ান কিনা, এগুলোও দেখা দরকার মনে করি।’

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, ‘ইংরেজি, গণিত এবং আইসিটি বিষয়ে দুর্বলতার কারণেই এ বছর ফল খারাপ হয়েছে।’ ফল প্রকাশের সময় তিনি আরও বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থী হয়তো যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ফেল করেছে, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, গলদ আছে ।’

এহসানুল কবির বলেন, ‘এমন বাস্তবতা আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। আমরা সেটা ফ্যাব্রিকেট (বানানো) করিনি। এ ফলাফল খারাপের পাশাপাশি রিয়ালও (বাস্তব) বলা যায়। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ব্যাপারে বিমুখ, টেবিল থেকে দূরে ছিলো বলে আমরা ধারণা করছি। সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের পরবর্তী দায়িত্ব এর কারণ অনুসন্ধান করা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যা অনেক সময় শিক্ষাবান্ধব হয়েছে কখনো রাজনীতি বান্ধব। রাজনৈতিক ইচ্ছায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করার প্রবণতা আমরা দেখেছি যা শিক্ষার্থীদের নিজেদের যোগ্যতায় ভালো ফল করার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এতোদিন যে ফলাফল দেখানো হয়েছে সেটি ছিল রাজনৈতিক। এবারের ফলাফল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র অনেকাংশে তুলে ধরেছে বলেই মনে করি।’

শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ। তিনি বলছেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ আছে কি না আছে সেটি রিসার্চের বিষয়। আমরা এক কথা বলে দেই কিন্তু এভিডেন্স বেজড নয়, এটা তো সমস্যা।’

শিক্ষার পলিসিগত পরিবর্তনের কথাও বলছেন তিনি। অধ্যাপক রশিদ আরও বলেন, ‘শুধু রেজাল্টই যথেষ্ট নয়, শিক্ষার্থীদের যা শেখা প্রয়োজন সেটি তারা শিখছে কিনা, যে অ্যাটিটিউড তাদের ডেভেলপ করার কথা সেটি হচ্ছে কিনা এগুলো দেখতে হবে।’

শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, পাসের হার কম হওয়া মানে শিক্ষার মান স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমেছে, তা নয়। বরং শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা, নির্ধারিত সময়সূচি, শিক্ষকতা পদ্ধতি ও শিক্ষার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। পাসের হার কম হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য সতর্কবার্তা, যাতে তারা আরও মনোযোগীভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জের জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।