তারুণ্যের বাতিঘর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা

রাইহান রাইন
রাইহান রাইন  © টিডিসি ফটো

শৈশবে প্রিয় বিষয় ছিলো গণিত। উচ্চমাধ্যমিকে পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষিত হন প্রবলভাবে। বস্তুজগৎ নিয়ে যে রহস্য তাকে এক অদ্ভুত জগৎ মনে হত। উচ্চশিক্ষার জন্য পছন্দের বিষয় ছিলো পদার্থবিজ্ঞান। কিন্তু দর্শনে ভর্তি হয়ে খুঁজে পান সাহিত্যের মূল শেকড়। শৈশব থেকেই লেখার অভ্যাস। তাই দর্শন ও সাহিত্য এসে এক বিন্দুতে মিলিতি হয়েছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও লেখক রাইহান রাইনের ব্যক্তিত্বে।

গল্পটি তার এমনি অভাবনীয়। জন্ম স্বাধীনতার বছরে উত্তাল মার্চে। শৈশব কেটেছে সিরাজগঞ্জে। পড়তেন বিএল স্কুলে। ছোট থেকেই লিখতেন ছড়া। পাঠাগারে বই পড়াও ছিলো একটা নেশা। স্কুল বোর্ডিং এর পাশেই পাঠাগার। তখন সিলেবাসের বই আর বাইরের বইয়ে পার্থক্য ছিলো না তেমন। তাই পাঠাগারের বইগুলোতেও ছিলো সমান আগ্রহ।

অভ্যস্ত লেখালেখিতে। ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে তা নিয়ে চিন্তিত নয়। একসময় রাজশাহী রেডিওতে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই অনুষ্ঠান পরিচালক হওয়ার আগ্রহ জন্মায়। তাই তথ্য ক্যাডার হওয়ার সুপ্ত বাসনা কাজ করতো। কিন্তু লেখালেখির সাথে পরিচালকের ব্যস্ততা ও শিডিউলভিত্তিক কাজে অমিল থাকায় তা আর হয়ে উঠেনি। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ফলাফল নতুন স্বপ্ন বুননে ব্যস্ত। শেষপর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষেই জাহাঙ্গীরনগরে শিক্ষকতার জন্য পেশাগত জীবনের প্রথম ভাইভা দেওয়া হলেও প্রথমবার সফলতা আসেনি। মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে। প্রচুর লিখতেন। আবু হাসান শাহরিয়ারের সম্পাদনায় খোলা জানালা বের হতো মুক্তকণ্ঠে। সেখানে মাসে দুই/তিনটা লেখা প্রকাশিত হতো। লেখালেখি করে আয় ছিলো জীবনের প্রথম উপার্জন। ২০০০ সালে প্রতিটা লেখার জন্য পাওয়া ৭০০ টাকায় মোটামুটি চলে যেতো তার। মাঝে দ্বিতীয় চেষ্টা হিসেবে রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজে শিক্ষকতার জন্য মৌখিক পরীক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও আশাজাগানিয়ার মতো কিছু হয়নি। অবশেষে আবারো জাহাঙ্গীরনগরে আবেদন এবং নিজ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা জীবন শুরু ।

পরিবারের প্রায় সবাই শিক্ষক। তাই অন্য পেশার চেয়ে শিক্ষকতা পেশাই প্রাধান্য পেয়েছে। শিক্ষকতার পেশা তিন হাজার তিনশ টাকার স্কেল দিয়ে শুরু করেছিলেন। যদিও অন্য পেশার তুলনায় টাকা কম ছিলো কিন্তু তার জন্য পর্যাপ্ত ছিলো। কারণ তিনি চেয়েছিলাম এমন একটি পেশা যেখানে লেখালেখির কাজটা চালিয়ে যেতে পারবেন। ফলে টাকাটা খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চার সুযোগটাই মুখ্য ছিলো।

দর্শন পড়ার ক্ষেত্রে প্রেরণার ব্যক্ত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসান আজিজুল হক স্যার। রাজশাহীতে থাকতে স্যারের সাথে অনেক আড্ডা দিয়েছেন। প্রবন্ধ লিখে কিছু পুরষ্কারও স্যারের হাত থেকে নিয়েছিলেন। আর দর্শনে পড়লে যে সাহিত্যে ভালো করা যায় তা স্যারের কাছে পাওয়া। সাহিত্যের শিকড়ের জায়গাটাই দর্শন।

লেখালেখির অনুপ্রেরণা আসলে বেড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে। শৈশব থেকেই ছড়া লিখতেন। বন্ধুরা পড়তো, ভালো লাগতো। সাহিত্য রূপ নেয় আত্মজৈবনিক ব্যাপারে। কোন ঘটনা ও জীবনের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যে রূপান্তর। ঐক্য ও শব্দের মধ্যমে রূপ নেয় সৃজনশীলতা। দৈনন্দিন ব্যবহারের শব্দগুলোকে একটি শিল্পের ও সাহিত্যের মোড়ক দেয়া শিখেছেন। তাইতো র্লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, কবিতা। করেছেন অনুবাদ ও সম্পাদনা।

তার লেখা বইয়ের সংখ্যা ১৪। গল্প লেখার শুরু ছাত্রাবস্থায়, নিসর্গ ছোটকাগজে, ১৯৯৬ সালে। বই-উপন্যাস: আগুন ও ছায়া ; গল্প: আকাশের কৃপাপ্রার্থী তরু, পাতানো মায়ের পাহাড়, স্বপ্নের আমি ও অন্যরা ; কবিতা: তুমি ও সবুজ ঘোড়া, একদিন সুবচনী হাঁস ; অনুবাদ: মনসুর আল-হাল্লাজের কিতাব আল-তাওয়াসিন (২০১০), পাবলো নেরুদার প্রশ্নপুস্তক ; সম্পাদনা: বাংলার ধর্ম ও দর্শন। এছাড়া দুটি বই প্রথমা প্রকাশনীর মননশীল ও সৃজনশীল ক্যাটাগরিতে পুরষ্কৃত হয়েছে। ‘আগুন ও ছায়া’ উপন্যাসটি ১৪২০ বঙ্গাব্দে এবং ‘বাংলার দর্শন: প্রাক-উপনিবেশ পর্ব’ ১৪২৫ বঙ্গাব্দে প্রথম আলো বর্ষসেরা বই হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে। করোনার সময়ে নতুন বই নিয়ে কাজ চলছে। বাংলা ভাষায় ‘অতীশ দীপংকরের রচনাবলী’ প্রকাশ। বইটি অনুবাদ ও সম্পাদনা করছেন। বইটি আগামীতে প্রথমা প্রকাশনীতে প্রকাশের জন্য কাজ চলছে।

ক্যারিয়ার গড়তে হলে তার ভাষ্যমতে, কোন সর্টকাট পথ নেওয়া যাবেনা। প্রত্যেককেই নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। এর জন্য ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও সংষ্কৃতি সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা থাকলে যে কেউ তার নিজ নিজ পেশায় সফল হবে। একাগ্রতার সাথে চেষ্টা করলে সকল বাঁধা অতিক্রম করা সম্ভব। শিক্ষকতা ও লেখা নিয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ লিখতে চাইলে সবার আগে লিখতে বসা উচিৎ এবং দেখা দরকার যে লেখা হচ্ছে কিনা। লেখালেখির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকতা একটি চমৎকার পেশা। এখানে যেমন স্বাধীনতা আছে তেমনি স্বাধীনতা কিভাবে কাজে লাগাবো তা নিয়ে নিজের মধ্যে অনেক বুঝাপড়াও করতে হয়েছে। এখনও শিক্ষার্থীদের সাথে ক্লাস ও ক্লাসের বাইরে কাটানো সময়গুলো উপভোগ করি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মানে চিরতরুণ। তরুণদের মাঝে কাজ করার সৃজনশীলতা ও আনন্দ নিজেকে প্রতিনিয়ত সৃমদ্ধ করে।’


সর্বশেষ সংবাদ