বেদে পল্লিতে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছেন শাবি ছাত্র
ক্ষুধা মেটাতে কোনরকম ভাত-আলু-ডাল খেয়ে ৪-৫ জনের একটি পরিবারের একবেলা টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন ৬০ টাকা। এই ধারণা থেকেই ‘প্রজেক্ট ৬০’ শিরোনাম নিয়ে বেদে সম্প্রদায়ের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এস এম নাঈমুল হাসান।
দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে নিন্ম আয়ের মানুষের সঙ্গে অসহায় হয়ে পড়ে বেদে পল্লীর বাসিন্দারাও। কাজ না থাকায় কষ্টে দিন পার করছিলেন তারা। তাদের সহযোগিতা করার জন্য ‘প্রজেক্ট ৬০’ নামে ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ শাবিপ্রবি ছাত্র নাঈমুলের।
নাঈমুল হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্বপ্নোত্থান’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশীপ সেন্টারের ক্যাম্পাস এম্বাসেডর এবং সাবেক স্পন্সর কো অর্ডিনেটর, হাল্ট প্রাইজ এট সাস্টের সাবেক স্পন্সর কো-অর্ডিনেটর। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের নিয়মিত ছাত্র।
‘প্রজেক্ট-৬০’র উদ্যোক্তা এস এম নাঈমুল হাসান বলেন, যখন ‘প্রজেক্ট ৬০’র কাজ শুরু করি, আমার প্রাথমিক টার্গেট ছিল ২-৩টি বেদে পল্লীকে ১ মাস ধরে খাদ্য সহায়তা করা। কিন্তু মানুষের আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক সহায়তায় এই ‘প্রজেক্ট ৬০’ মোট ২১টি বেদে পল্লীতে খাদ্য এবং চিকিৎসা সহায়তায় দেয়া হয়েছে। এই মানুষগুলোর সহায়তা ছাড়া কোনভাবেই এ পর্যন্ত আসা সম্ভব হতো না। এ মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা।
‘প্রজেক্ট ৬০’ খাদ্য ও চিকিৎসা বিতরণে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করছে। যেমন- গান, কবিতা, রোবোটিক্স, নাটকের পাঠাভিনয়। এসব বিষয় নিয়ে জুম লাইভ আড্ডার আয়োজন করেন তিনি। এ লাইভ আড্ডায় যোগদানের জন্য টিকেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ টাকা। টিকেট কাটলেই জুমের আইডি পাসওয়ার্ড দিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে মোট ২১ দিনে ৯টি লাইভ আড্ডা আয়োজন করা হয়েছে।
দেশের ১১টা বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, শাবিপ্রবি, ঢাবি, রাবি, জাবি, ইস্ট ওয়েস্ট, বুটেক্স, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি) শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘প্রজেক্ট ৬০ ন্যাশনাল লুডো কম্পিটিশন’ এর মাধ্যমেও অর্থ সংগ্রহ করেছেন নাঈমুল। এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন ফি ছিল ৩০ টাকা। এতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, রানার আপ হয়েছেন কুয়েট এর সমরাজ ফারাবী এবং তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে যথাক্রমে মিনহাজুল আবেদীন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং আশিক আহমেদ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)।
এই চারজন প্রতিযোগীকে একজন শিল্পীর এঁকে দেয়া ডিজিটাল পোর্ট্রেইট গিফট করা হয়েছে। এভাবে সারাদেশের ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী যুক্ত হয়েছেন এই আয়োজনের সাথে।
সহায়তা অব্যাহত রাখতে যাকাতের টাকা তোলা হয়েছে এবং ‘ডোনেট-ইউর-সালামি’ দিয়ে ঈদের দিন সালামীর জন্য আহ্বান করা হয়েছে। পাশাপাশি শাবিপ্রবির আরেকজন উদ্যোক্তা সত্যজিৎ শুভর উদ্যোগ ‘ডিগবাজি’কে সাথে নিয়ে জয়েন্ট ভেনচারের মাধ্যমে ‘কেএন৯৫’ মাস্ক বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লাভের বিশাল একটা অংশ ‘প্রজেক্ট-৬০’কে ডোনেট করেছে ‘ডিগবাজি’।
এসব কার্যকর উদ্যোগের সফলতা স্বরূপ এসেছে প্রায় ২ লাখ টাকা। ‘প্রজেক্ট ৬০’ খাদ্য এবং চিকিৎসা এই দু’টি সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মোট ৮টি বিভাগের ২০টি বেদে পল্লীর সাথে সংযুক্ত হয়েছে ‘প্রজেক্ট-৬০’। তাদের যেকোন শারীরিক সমস্যায় তিনজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ পৌঁছে দেয়া হয়েছে সাথে সাথেই।
পাশাপাশি কোভিড-১৯ বিষয়ক যেকোন তথ্য সংগ্রহ করেও তাদেরকে সাহায্য করা হয়েছে। এছাড়াও দেশের ৭টি বিভাগের ১৬টি বেদে পল্লীর মোট ২৫১টি পরিবারের মাঝে খাবার যোগাতে সফল হয়েছে ‘প্রজেক্ট ৬০’।
‘প্রজেক্ট-৬০’ তাদের সহায়তা কার্যক্রম শুরু করে মৌলবীবাজারের ভানুগাছ বেদে পল্লী থেকে। পরবর্তীতে বরিশালের রসূলপুরের বেদে পল্লীতে এবং ধীরে ধীরে মোট ১৬টি বেদে পল্লীতে কয়েক দফায় খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। শুধু একবেলা খাবারই নয় বরং প্রায় সবগুলোতে ২ বেলা এবং কয়েকটাতে ৩ বেলা করেও খাবার দেয়া হয়েছে।
এস এম নাঈমুল হাসান বলেন, বেদে পল্লীর মানুষগুলো আমার প্রতি যতটুকু ভালোবাসা দেখিয়েছে সেটা অসামান্য। আমি যখন কোভিডের সিম্পটম নিয়ে ঘরে বন্দী, প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন বেদে পল্লীর সর্দার আমাকে ফোন দিয়ে খবর নিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। এতোটা সম্মান এবং ভালোবাসা আমি কখনোই আশা করিনি।
এ ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে জানিয়ে নাঈমুল বলেন, স্বপ্নোত্থানে (স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন) কাজ করবার সময় থেকে মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। যেখানেই থাকি, যে অবস্থাতেই থাকি মানুষের জন্যে সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারি, কাজ করে যাবো। ‘প্রজেক্ট ৬০’ আমাকে আরেকটু সাহস যুগিয়ে দিলো। ভবিষ্যৎ কি হবে তা তো কেউ জানেনা, তবে ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকবে আজীবন।