স্বামীর ঘর ছেড়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রুখসানা বললেন— আমার গল্পটা বক্সিংয়ের চেয়ে বড়
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ কিক বক্সার রুখসানা বেগম। লন্ডনে জন্ম নেয়া এই মেয়ের গল্পটা যেন এই দেশের লড়াকু মেয়েদের প্রতিচ্ছবি। শত বঞ্চনা, গঞ্জনা আর প্রতিকূলতা পেরিয়ে জীবনযুদ্ধে লড়াই যেন বাংলার মেয়েদের নিত্যসঙ্গী। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফল হতে হলে লড়াই করেই তাদের জয়ী হতে হয়। রুখসানার গল্পটাও তেমন চিত্রনাট্যে লেখা।
চার বছর আগে জিতেছেন বিশ্ব কিক বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। ২০১১ সালে জেতেন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ। প্রায় চার বছর ধরে ব্রিটিশ জাতীয় মুয়ে থাই (কিক বক্সিংয়ের বিশেষ একটি খেলা) দলের অধিনায়ক। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে খেলেছেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে।
সম্প্রতি ইংল্যান্ডে বের হয়েছে তাঁর বায়োগ্রাফি— ‘বর্ন ফাইটার’। বইটা ছাপা হতেই ইংলিশ গণমাধ্যমে শুরু হয়েছে রুখসানাকে নিয়ে হইচই। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে এক সাক্ষাৎকারে নিজের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর সেই লড়াইয়ের গল্পটাই শুনিয়েছেন তিনি।
সিলেটের বালাগঞ্জের মেয়ে রুখসানা যখন খেলা শুরু করেন পরিবারের কেউই সেভাবে সমর্থন দেয়নি। ২৩ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাবা-মা। স্বামী লন্ডনের এক ব্যাংকার। আগে থেকে পরিচয়ও ছিল না স্বামীর সঙ্গে। আর বিয়ের পর দাম্পত্য জীবনটাও সুখের ছিল না রুখসানার।
পড়াশোনা শেষ করে স্থাপত্য বিদ্যায় ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু পড়াশোনা আর সংসার সামলানো এক সঙ্গে ভীষণ কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল রুখসানার। এক সময় অবসাদে ভুগতে শুরু করেন। শ্বশুর বাড়িতে মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে দিন কাটতো। ওই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে। কিন্তু বাবা-মাও তাকে স্বামীর কাছে পাঠানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য স্বামী তাকে বিয়ে বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠান।
স্বামীর নোটিশটা যেন মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে রুখসানার জীবনে। সেই গল্পটা শোনানোর সময় চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছিল রুখসানার, ‘২৩ বছর বয়সে বিয়ে ঠিক হয়। লোকটাকে ভালোমতো চিনতাম না। তাকে দেখে খুব ভয় পেয়ে যাই। মাকে বললেও কাজ হয়নি। তিনি বলেন, সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন কিছু করার নেই।’
স্বামীর ঘরে গিয়ে প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রণা সইতে হতো রুখসানাকে। তিনি জানান, ‘আমি খুব হতাশ হয়ে পড়ি। সংসারের কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। কিন্তু ভয়ে কাউকে বলতেও পারতাম না।’ অবস্থা এত খারাপ হয় যে অকারণে আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন। অবশেষে বিয়ে বিচ্ছেদের নোটিশ পাওয়ার পর রুখসানার বাবা মা বিষয়টা বুঝতে পারেন।
এরপর অবসাদের জন্য চিকিৎসা নিতে শুরু করেন রুখসানা। মা-বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শুরু করেন কিক বক্সিং খেলা। কিন্তু যে জিমনেসিয়ামে অনুশীলন করতেন, সেখানেও আরেক নারী খেলোয়াড় প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা দিতেন। কোনো কারণ ছাড়াই তাকে হেনস্তা করতেন।
এসবের সঙ্গে লড়াই করেই প্রথমবার ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য রিংয়ে নামেন। লড়াইয়ের সময় রিং কর্নারে তাঁর পাশে কেউ ছিল না। কয়েক রাউন্ড খেলার পর এক ডেনিশ কোচের নজরে পড়েন রুখসানা। ওই কোচ বুঝতে পেরেছিলেন চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে মেয়েটি। তখন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন ওই কোচ।
২০১৬ সালে রুখসানা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের শিরোপা জেতেন। রিংয়ে নেমেই যেন জীবনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব অন্যায়ের জবাব দিতে চাইতেন। রিংয়ে শুধু প্রতিপক্ষকে আউট করতেন না, একই সঙ্গে চাইতেন জীবনের সব ব্যর্থতা আর যন্ত্রণাকে দূর করে দিতে। চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জিতে যেদিন বাড়ি ফেরেন, সেই স্মৃতি আজও ভোলেননি, ‘বাবা বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে আমার জয় উদ্যাপন করতে ছুটে এসেছিল।’
ভেতরের কষ্টটা চেপে রেখে রুখসানা বলছিলেন, ‘আমার গল্পটা বক্সিংয়ের চেয়ে বড়।’ সত্যিই তো রিংয়ের নীল ক্যানভাসে ছড়িয়ে পড়া রুখসানার অশ্রু কোনো মেয়ের দুর্বলতার গল্প না। পরোক্ষে এ যেন এক বাঙালি মেয়েরই লড়াকু জীবনের গল্প।